Saturday, June 25, 2011

কেন আশা বেঁধে রাখি---

জীবনে এতদিন বেকার বোধহয় আগে কখনো ছিলাম না---
কে জানে হয়ত বা ছিলাম।
অনেক দিন ধরে এই পৃথিবীতে পড়ে আছি। সব কিছু আগের মত মনেও পড়ে না। মনে পড়ে শুধু ছেঁড়া ছেঁড়া দৃশ্যপট---স্কুল ছুটি-- মায়ের সাথে করে ঘরে ফেরা-- মাঝে মাঝে কারেন্ট চলে যাওয়া রাতে ঘি দিয়ে ভাঁপ ওঠা সাদা ভাত খাওয়া--- পাখি ধরার ফাঁদ পেতে সারা দুপুরের রোদ মাথায় নিয়ে বসে থাকা--- সন্ধ্যা বেলায় শিয়ালের দলের গর্বিত হুকুৎকার (হুক্কা হুয়া বলে চিৎকার-- শব্দটা মাত্র তৈরি করলাম--হে হে হে) শুনে গুটিশুঁটি মেরে বাবার কাছে গিয়ে বসা, শীতের দিনে সকালে উঠে মুখ হাঁ করে ধোঁয়া বের করা এবং অদৃশ্য সিগারেট খাচ্ছি এমনটা ভেবে নিজের মনে মনেই হাসা---

স্মৃতির পর স্মৃতি, দৃশ্যের পর দৃশ্য

এখন বেকার হয়ে আমার অখন্ড অবসর। আগে যে স্মৃতিগুলো কাছে ভীড় করার সময় পেত না---এখন তারা সকাল হতেই আমার কোলে উঠে বসে থাকে। আগে যে সব স্মৃতিকে কড়া শাসনে রাখতাম--এখন তাদের ডেকে ডেকে দুধ-কলা খেতে দেই---তারা আমার ঘরের ছাদে বসে সারা দিনমান বাক-বাকুম করে।
এক নিরাময় অযোগ্য আলসেমিতে পেয়ে বসেছে। কোন কিছুই করতে মন চায় না।
খালি মনে হয়--অনেক তো হল--এবার খানিক দম নে বেটা!
মাঝে মাঝে মনে হয়---কী ভীষন তাড়াতাড়ি আমার দম ফুরিয়ে গেল এই পৃথিবীতে। লোকজন দেখি দিন-কে-দিন অধরাকে ধরার আশায় ছুটছে দিক-বিদিক। আমার বয়েসী কতজনকে দেখি এখনো যেন সতেরো বছরের কিশোর।
আমিই কেন জানি বুড়োটে মেরে গেলাম। এ নিশ্চয়ই আমার উল্টা-পাল্টা সব গান শোনার ফল! আমি যখন ইস্কুলে থাকতেই ক্ল্যাসিকেল গান শোনা শুরু করলাম--আমার আত্মীয়ের মন্তব্য ছিল---এইসব তো বুড়োদের গান--তুই এই বয়েসে এইসব শুনছিস কেন?
কে জানে, তার কথাই ঠিক হবে হয়ত-- এইসব শুনে শুনেই---

জীবনে আরেকটা দুঃখ আমার কখনো যাবে না।
টাকা-পয়সা আমার জমানো হল না। অর্থ নিয়ে আসলে সেই অর্থে আমার কোন মুগ্ধতা বা লোভ নেই। বরং উল্টা---এক ধরনের বিরাগ আছে, মমত্বহীনতা আছে। কখনো বুদ্ধিমানের মত টাকা জমানো শিখিনি। এইটা যে আসলে জমানো যেতে পারে এই ধারণাটাই কেন জানি উপাদেয় মনে হয়নি নিজের কাছে। ফলে টাকা এসেছে---উড়িয়ে ফেলেছি। যার খেসারত এখন দিচ্ছি। টাকা খুব নির্মম ভাবেই আমার উপর প্রতিশোধ নিয়েছে। আকন্ঠ ঋণের সমুদ্রে ডুবে আছি। মাসের শুরুতে যা পাই--- ক্রেডিট কার্ড আর যাবতীয় দেনা শোধ করতে গিয়ে কিছুই হাতে থাকে না।
আমার বেতন যেন অনেকটা স্বৈরিনী। নামে মাত্র আমার---তার আসল ভোক্তা অন্যেরা। সে আসে---সে চলে যায়---
গতকাল দেখলাম ব্যাঙ্কে মাত্র ৩২ টাকা আছে। ভাবছিলাম ৩২ টাকা দিয়ে কি করা যায়? প্রতিদিন ম্যাকডোনাল্ডের ডলার মেনু খেলে এক মাস বাঁচতে পারব---কিন্তু খালি পেট ভরানো তো শেষ কথা নয়। ৩২ ডলার দেশে কত টাকা? ৩২ x ৭০=২২৪০ টাকা। এই টাকায় কি দেশে এক মাস টেকা সম্ভব?
 অনেক সময় গেছে ব্যাঙ্কে ৩ টাকা পড়ে আছে। সে খেয়াল নেই। গেছি কফি খেতে। কফি খেতে সাথে বন্ধুও গেছে। দুইজনের কফির দাম এসেছে ৬টাকা। খুশি মনে বাসায় ফিরেছি। পরে যখন ব্যাঙ্ক স্টেটমেন্ট চেক করেছি--দেখেছি ঐ বাড়তি ৩ টাকার জন্য ৩৫ ডলারের ওভার ড্রাফট খেয়েছি।
এরপরও লজ্জা হয় নি।
এমনও হয়েছে--ম্যাকডোনাল্ডে গেছি বা বার্গার কিং এ গেছি। অর্ডার দিতে গিয়ে ঘামছি। দেখা যাবে হয়ত ব্যাঙ্কে টাকা নেই---কার্ড ঘষার পর বলবে--Sorry, your card has been declined! Do you have any other card? আমি মাথা নীচু করে বেরিয়ে আসি। মাথা ঘুরিয়ে না দেখলেও টের পাই কয়েক জোড়া চোখ অনুকম্পার চোখে হয়ত তাকিয়ে আছে।


শুধু এইসব কারণে মাঝে মাঝে লক্ষ্মীছাড়া-রকমের বড়লোক হতে ইচ্ছে করে---
রোজা রাখলে সারা দিন ঘুমুতাম আর কেবল খাবারের স্বপ্ন দেখতাম।
এখন আমি বেকার---ব্যাঙ্কে ৩২ টাকা--- No wonder I am dreaming about money!!

Thursday, June 9, 2011

রাতের গল্প


'ভাইয়া খেয়েছে?'

আসমা'র মা মাথা নাড়ে।টেবিলে আয়োজন যৎসামান্য। কিন্তু এক প্লেট সাদা ভাঁপ ওঠা ভাত, একটু সর্ষে-মাখা আলু ভর্তা আর টেংরা মাছের ঝোল---এদের মাঝে কিছু একটা আছে যা ভীষন সুখকর---মানুষের সুখী হবার জন্যে আর কি খুব বেশি কিছুর প্রয়োজন ?

সালাম কে জিজ্ঞেস করলে উত্তর পাবেন--'না'।

সালাম একটা প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে পড়ায়। বেতন খারাপ না। পড়ানোর চাপও তেমন বেশি কিছু না। বাপ-বেটা মিলে দুইজনের এই সংসারে খরচের বাহুল্য নেই বললেই চলে। ইদানিং অবশ্য রাহাত, সালামের ছেলে, টিউশনি ধরেছে একটা। তার নিজের ফোনের বিল আর ইন্টারনেটের বিল সেই দেয়। ইউনিভার্সিটিতে সদ্য সদ্য দাখিল হলে নতুন যে যে উপসর্গ  দেখা দেয় সেসবের খরচা হয়ত সালাম খুশি মনেই মেটাত। রাহাত সেসবের ব্যাপারেও বাবাকে জড়ায় না তেমন। এই নিয়ে সালামের মনে কিঞ্চিত দুঃখবোধ রয়েছে।

এইসব কিছু ছোটখাট জিনিস বাদ দিলে সালামকে একজন গড়পড়তা সুখী মানুষ বলে অনায়াসেই চালিয়ে দেয়া যায়।

আলু ভর্তা দিয়ে ভাত মাখাতে মাখাতে আসমা'র মা কে জিজ্ঞেস করল সালাম
'ভাইয়া কই? রুমে? নাকি বারান্দায়?'
'বারান্দায় দেখসি আধাঘন্টা আগে---একলা একলা বইয়া রইছে--আর--'

এইটুকু বলে আসমা'র মা মুখ টিপে হাসে। সালামে'র কেন জানি 'আর কী করে?' জিজ্ঞেস করতে মন চাইল না। এক মনে মাথা নিচু করে খেয়ে যেতে লাগল। আজ প্রায় দুই সপ্তাহ হতে চলল তারা বাপে-বেটায় একসাথে রাতের খাবার খায় না। এইটা প্রায় অলিখিত একটা চুক্তির মত ছিল তাদের মাঝে। সারাদিনে দেখা হয় না। কিন্তু রাতের খাবার তারা দুই জন এক সাথেই খায়। খেলা নিয়ে, পলিটিক্স নিয়ে, মায় গ্রামীন ফোনের নতুন এড নিয়ে নিত্যদিনের ঝগড়াঝাটি কথা কাটাকাটির মাঝে কিছু একটা নেশার মতো ছিল---যে কারণে রাহাত তার টিউশনির টাইম পর্যন্ত এদিক-সেদিক করেছে রাতের খাবার মিস না করার জন্য। সালামের গ্রাস্ট্রিকের যন্ত্রণা শুরু হবার পর থেকেই রাহাত নিজ উদ্যোগে রোজ রাত ন'টার মাঝে খাওয়ার নিয়ম ঠিক করেছে।  পরীক্ষা বা কোন জরুরি মিটিং না থাকলে সালাম সন্ধ্যে হতেই লিভিংরুমের সোফায় আটক।

এই ব্যাপারটা সালাম কে ভাবাচ্ছে কয়েকদিন ধরেই। এমনিতেই তার একা খেতে ভাল লাগে না। কারোরই লাগে না। প্রথমে ভেবেছিল সাময়িক কোন কিছু। এখন মনে হচ্ছে আর বেশি দেরী না করে রাহাতের সাথে কথা বলা দরকার। একজন বাবা'র তার সন্তানের সাথে যতটুকু বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক থাকলে ছেলেরা বাবাকে 'বড়ভাই' এর কাতারে নামিয়ে আনে---সালামের ধারণা, তাদের মাঝের সম্পর্ক চেয়ে বেশি বৈ কম কিছু নয়। তবে এইটা সালামের নিজের ধারণা। রাহাত নিজে কী ভাবে সেটা তার জানা নেই। সালামের শুধু মনে আছে তার নিজের বাবার সাথে তার কি রকম আড়ষ্ট সম্পর্ক ছিল। ক্লাস এইটে ওঠার পর হঠাৎ করে তার বাবা ঘোষনা দিয়ে বসলেন--তাকে এখন থেকে 'আপনি' 'আপনি' করে বলতে হবে। ছেলেপিলেরা বাবা-মা কে তুমি করে ডাকলে 'বেত্তমিজের' মত শোনায়। ক্লাস এইটে ওঠার পর হঠাৎ করে একজনকে 'তুমি' থেকে 'আপনি' করে ডাকাডাকি শুরু করাটা মোটামুটি অস্বস্তিকর ব্যাপার। কিন্তু সালামের মোটেও অসুবিধা হয় নি। উলটো একরকমের স্বস্তি কাজ করেছে বলেই সে মনে করে। কিন্তু তার মা'র আর 'আপনি'-তে প্রমোশন হয়নি। তিনি 'তুমি'-র ঘেরাটোপেই আটকে ছিলেন শেষাবধি।

ভাত খেয়ে উঠে হাত মুছতে মুছতে সালাম আসমা'র মা কে বলল এক কাপ চা আধা ধন্টা পর বারান্দায় দিয়ে আসতে। সরু করিডোর ধরে বারান্দার পথে যেতে যেতে হঠাৎ করে প্রায় ভুলতে বসা একটা অনুভূতি সালাম কে গ্রাস করে নিল। অনুভূতিটির নাম 'বিপন্নতা'!


গ্রীল দেয়া বারান্দাটার এক কোনায় রাখা ছোট দু'টি মোড়ার একটায় বসে আরেকটায় পা তুলে সিগারেট ফুঁকছে রাহাত।বারান্দায় কোন লাইট নেই। কেবল তার অস্থির হাতের প্রান্তে একটা আলোক বিন্দু ছুটোছুটি করে বেড়াচ্ছে, মাঝেমাঝে নিবু-নিবু হয়েই পর মুহূর্তেই যেন কোন সুখবর পাবার আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠছে!

হালকা একটা গলা খাকাড়ি দিয়ে সালাম বলল, কি হে ইয়াং ম্যান?
প্রথমে একটু চমকে উঠলেও দ্রুত সিগারেট আড়াল করতে করতে রাহাত বলে উঠে ,হ্যালো ওল্ড ম্যান--তুমি তো আমাকে ভড়কে দিয়েছ রীতিমত!

-সরি, তোর সিগারেট খাবার আনন্দের মুহূর্তে বাগড়া দিলাম বলে---ওয়েল, লেট মি টেইক ইট ব্যাক---তোর সিগারেট খাবার আনন্দে বাগড়া দিতে পেরে আমি অতিশয় আনন্দিত--!!

হো হো করে হেসে উঠল রাহাত। অন্ধকার তাদের দু'জনের মুখ আড়াল করে রাখায় তারা জানতেও পারল না যে দুইজন আসলে একই সাথে দুজনের দিকে তাকিয়ে প্রশ্রয়ের ভঙ্গিতে হাসছে।

মোড়া এগিয়ে দিতে দিতে রাহাত বলল, তারপর বা'জান, তোমার খবর-টবর কী?
-আমার তো ভালই, তোর খবর বল--দিনে কয়টা করে খাস?
সাধু-সাজার একটা শেষ চেষ্টা চালাল রাহাত,দিনে কয়টা মানে? কী বলতে চাইছ তুমি?

খুব আরামে কানটা মোচড় দিতে দিতে সালাম বলল, এই তোর স্টীমারের মত থেকে থেকে ধুম্র-উদ্গীরণের কথা জানতে চাইছি আর কি--

বাবা'র হাত থেকে কানটা ছাড়িয়ে নিয়ে তাতে হাত বুলোতে বুলোতে বলল
-বা'জান তুমি না আসলেই ইম্পসিবল!! কাউকে কখনো সাধারণ কথাবার্তায় 'ধুম্র-উদগীরণ' শব্দটা ব্যবহার করতে শুনেছ? আমি তো লাস্ট পাঁচ বছরে কাউকে 'ধুম্র' শব্দটাই উচ্চারণ করতে শুনি নি---

--কথা ঘোরাস না, যেটা জিজ্ঞেস করেছি সেইটার উত্তর দে
--আরে কী মুস্কিল, আমার নামে এইসব কী যা-তা কলঙ্ক রটাচ্ছ তুমি?
-- রা--হা--ত
--ঠিকাছে রে বাবা, দুইটা---দিনে দুইটার বেশি না!
--একটু পরে আসমা'র মা চা নিয়ে আসবে আমার জন্যে। তখন তাকে বলব বারান্দার লাইটটা অন করতে। যদি তখন দেখি এই বারান্দায়  দুইটার বেশি সিগ্রেটের পাছা-----
--উফফ বা'জান, তুমি না ভীষন খ্যাত! সিগ্রেটের পাছা---ওফফ কী অসাধারণ চয়েস অব ওয়ার্ড--পাছা!!
--সিগ্রেটের পাছা কে তাহলে কী বলব বাছা?
--বলবে butt, সবাই যেমন বলে।
--ওয়েল আমাদের সময়ে আমরা ঐসব বাট-ফাট বলতাম না---স্রেফ বলতাম পু--
-- বা--বা, তুমি থামবে?

মাঝে মাঝে ছেলে কে বিব্রত করে সালাম বেশ আনন্দ পায়। এই বয়েসের ছেলেরা আরেকটু ডাকা-বুকো হয়। কথাবার্তায় আরেকটু উগ্র। অন্তত তার সময়ের মাপে রাহাতের কথাবার্তার স্টাইলকে অনেকেই হয়ত মেয়েলি বলে চালিয়ে নেবে।

এরই মাঝে আসমা'র মা চা দিয়ে গেল।

চায়ে চুমুক দিয়ে খানিকটা গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করল সালাম,
--পড়াশোনা কেমন চলছে রে?
--ভালই, খারাপ না।
-- কলেজ কেমন লাগছে?
--ভালই তো, খারাপ না।
--আমি এখন আরেকটা প্রশ্ন করব, সেইটার উত্তরেও 'ভালই তো খারাপ না' বললে তোর কপালে খারাপি আছে বলে দিলাম--

উত্তরে খানিকটা তরল গলায় হেসে রাহাত বলল,আচ্ছা যাও, এখন সিরিয়াস হয়ে উত্তর দেব।

সালাম দীর্ঘ সময় নিয়ে চায়ে চুমুক দিল। মনে মনে কথাগুলো সে সাজিয়ে নেবার চেষ্টা করল। এই কথাগুলো কী ভাবে জিজ্ঞেস করবে বা কিভাবে জিজ্ঞেস করা উচিত--সেই নিয়ে গত কয়েকদিন রীতিমত নিজের সাথে যুদ্ধ করতে হয়েছে। আরো আগেই হয়ত জিজ্ঞেস করত---সাহসের অভাবে পারে নি।

-- সানি-টা কে?
একটু থেমে কিঞ্চিত অস্বস্তি ভরা গলায় রাহাত বলল, একটা মেয়ে।
--যাক, আমি আরো ভেবেছিলাম ছেলে মনে হয়, তাহলে তো সর্বনাশ হতো!

ভেবেছিল রাহাত কথাটায় হাসবে।
রাহাত হাসল না।
কিছুখন চুপ থেকে জিজ্ঞেস করল, তুমি সানি-র ব্যাপারে জানলে কী করে? তুমি আমার সেলফোনের এসএমএস চেক করছ নাকি আজকাল?ভালই--

--না তোর এসএমএস চেক করিনি। কিছুদিন আগে যখন ভোর ছটায় টেবিলে মাথা রেখে আপনি ঘুমাচ্ছিলেন তখন আমি আপনাকে টেনে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিয়েছিলাম, আশাকরি সেটা আপনার মনে আছে?

--আছে।

--তখন আপনার ডেস্কটপের মেসেঞ্জার উইন্ডোতে চোখ পড়ে যায়। সেইভাবেই জানা। দেখতে না চাইলেও কিছু জিনিস চোখে পড়ে যায়--আই ক্যুডনট হেল্প ইট! দ্যাটস ইট। এর বেশি কিছু না।

--হুমম। তো এখন আরো কিছু জানবার আছে তোমার? এই বিষয়ে?

--হ্যা আছে। আমি জানতে চাই তোমার সমস্যা কী।
--তুমি শুধু মুদু এক্সাইটেড হচ্ছ বাবা--
--আমি মোটেও এক্সাইটেড না।
--তুমি এক্সাইটেড। প্রমান দেব? তুমি আমাকে 'তুমি' 'তুমি' করে বলছ। তুমি সাধারনতঃ আপসেট না হলে এইরকমটা কর না। ঠিক বলেছি?

সালাম উত্তর দিল না।

কিছুখন চুপ থেকে সে আবার বলল,
--তোমার সমস্যাটা কী আমাকে বলবে?
--আমি যে কোন সমস্যায় আছি, সেইটাই বা তোমাকে কে বলল?

ঠকাস করে চায়ের কাপ বারান্দায় রেখে সালাম উঠে দাঁড়ায়।স্পষ্টতঃই সে মাথা গরম করে ফেলছে। অনেক কষ্টে নিজেকে সামাল দেবার চেষ্টা করতে লাগল---নিজেকে বার বার বলতে লাগল, রাগারাগি নয়, কোন রকম রাগারাগি নয়--

কিছুটা সামলে নিয়ে সালাম বলল, দেখ রাহাত, তুমি চাইলে আমি সারা রাত তোমার সাথে এই কথা চালাচালির খেলা খেলতে রাজি। সেইটা আখেরে তোমার দুঃখই বাড়াবে। তারচেয়ে বুদ্ধিমানের মত কাজ হবে যদি তুমি আমাকে এই ব্যাপারে সহযোগিতা করো। এখন তোমার ইচ্ছা--

--ঠিকাছে।
--ঠিকাছে কী?
--ঠিকাছে, মানে-- জিজ্ঞেস করো কী কী জানতে চাও।
--গুড, আমি যেমন আগেই বলেছি আমি প্রায় কিছুই জানিনা এই ব্যাপারে। আই জাস্ট হ্যাড আ গ্ল্যান্স অন দ্যাট চ্যাট উইন্ডো। ওয়ান্স এগেইন, ইট ওয়াজ টোটালি আন-ইন্টেনশনাল--
--আমি জানি বাবা, বার বার এইটা বলার দরকার নেই।
--ঠিকাছে।আমি তাহলে আমার কন্সার্ন হবার কারণটা খুব স্পষ্ট করে বলি,কেমন? সেদিনের পর থেকে তুমি স্পষ্টতঃই আউট অব সোর্ট। আজ দু'সপ্তাহ হতে চলেছে তুমি আমার সাথে রাতের খাবার খাও না। এমন না যে তুমি বাসায় নেই। বাসায় থেকেও তুমি আমার সাথে খেতে বসছ না। তুমি স্যারের কাছে পড়তেও যাচ্ছ না অনেকদিন। তুমি বোধহয় ভুলে গেছ তোমার অঙ্কের স্যার আমার বাল্যকালের বন্ধু এবং প্রায়ই তার সাথে আমার দেখা হয়।
আমি জানতে চাইছি, কী হয়েছে যা তোমাকে এমন বিপর্যস্ত করছে? সানি-র চ্যাট উইন্ডোতে আমি যা দেখেছি, সেইটা নিয়ে আমি কিছু বলতে চাই না। এইটা তোমাদের নিজেদের ব্যাপার। কিন্তু আমি মনে করি এমন কোন কিছু যদি ঘটে থাকে যেটা তোমার দৈনন্দিন জীবন-যাত্রাটা কে এতখানি ডিসরাপ্ট করতে পারে---সেটা আমার জানা দরকার, আই ডোণ্ট কেয়ার হোয়াট ইউ থিঙ্ক অব ইয়োরসেল্ভস, আই স্টিল এম ইয়োর ফাদার এন্ড আই হ্যাভ আ রাইট টু--

--কুল ডাউন বাবা। কুল ডাউন। ব্যাপার যতটা খারাপ ভাবছ ততটা কিন্তু নয়।সানি আমাদের ব্যাচের। কিন্তু আমাদের কলেজের না। জাহিদ স্যারের কাছে ব্যাচে পড়তে আসে। সেইখানেই পরিচয়। টুকটাক কথা-বার্তা মাঝে মাঝে হতো। মাঝে মাঝে এদিক সেদিক টুকটাক ঘুরে বেড়ানো।
--এসব কতদিন ধরে চলছে?
--উমম, মাস ছয়েক হবে।
--ক্যারী অন
--কয়েক মাস আগে আমি বুঝতে পারি যে আই এম ফলিং ফর হার! এন্ড ফলিং রিয়েল হার্ড। সেইটা এত কষ্টের সময় গেছে যে তোমাকে বলে বুঝাতে পারব না বাবা। সিগ্রেটটা সেই সময়েই ধরা।--যাই হোক, একদিন সাহস করে সানি কে বলি। সে শুনে বেশ চুপচাপ হয়ে যায়। পর পর ক'দিন আমার সাথে কথা পর্যন্ত হয় না। আমি তখন টেনশনে মারা যাচ্ছি--এমন অবস্থা। যখন ওকে বলেছিলাম তখন ভয় ছিল রিজেকশনের। কিন্তু এখন ভয় ছাড়িয়ে সেইটা একটা অদ্ভূত রকমের যন্ত্রণায় পরিনত হল। মনে হতে লাগল, এরচেয়ে সে 'না' বলে দিক--সেটাও ভাল।কিন্তু কিছু একটা অন্তত বলুক।

একটানা কথা বলে যেন একটু নিঃশ্বাস নেবার জন্যেই রাহাত থামল। সালাম ফেরত এসে বসেছে তার মোড়াটায়। দৃষ্টি দূরে নিবদ্ধ। রাস্তায় একটা ল্যাম্প পোষ্ট অল্প হাওয়ায় একটু একটু দুলছে। সেটারই আলো কিছু গাছের পাতার ফাঁক-ফোকর দিয়ে এসে তার মুখে পড়েছে। সে আলোয় তার পিতার মুখ থেকে রাহাত ঠিক বুঝে উঠতে পারে না সেটা কি গাঢ় কোন বিষাদের প্রতিচ্ছবি নাকি বিপন্নতার।

--যাই হোক, কিছুদিন পরে প্রায় জোর করেই ওকে জিজ্ঞেস করি। সে তখন বলে যে তার অলরেডি একজন পছন্দের মানুষ আছে। আমাদের কয়েক বছরের সিনিয়র। কিছুদিনের মাঝেই স্কলারশীপ নিয়ে দেশের বাইরে যাবেন। কাজেই যাবার আগে বিয়ে না হলেও অন্তত আকদ করে যাবে। মনটা আমার ভেঙ্গে গেলেও ওর ভালোর কথা ভেবেই আমি সিদ্ধান্ত নেই সরে আসার।মুস্কিল হল তারপরে--

--মানে?

--মানে সানি দেখা গেল ধীরে ধীরে আমার উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে।আগের চাইতে বেশি বেশি করে এসএমএস করে,ফোন করে। আমি চাইছিলাম ধীরে ধীরে নিজেকে সরিয়ে নিতে। কিন্তু সানি'র এইসব ব্যবহারের কারণে ব্যাপারটা দিনকে দিন ডিফিকাল্ট হয়ে উঠছিল।বুঝতেই পারছ--

--হুমম, তারপর?

--তারপর এই কিছুদিন আগে, তুমি যেদিন আমাকে টেবিল থেকে এনে  বিছানায় শুইয়ে দিয়েছিলে, সেইরাতে সানি আমাকে জানায় যে সে আসলে আমার প্রেমে পড়েছে। যার সাথে তার বিয়ে হবার কথা, সে লোকটা ভাল হলেও খানিকটা 'bossy'।তাদের দুই পরিবারের মাঝেই খুব ভাল বোঝাপড়া অনেকদিনের। এবং এইটা প্রায় সেটেল্ড ছিল যে একদিন ওদের দুইজনের বিয়ে হবেই। আমার সাথে পরিচয় হবার পর সে নিজেকে নতুন করে জানতে পারছে। আমার সাথে পরিচয় হবার পর সে নাকি মন খুলে হাসতে শিখেছে---এইসব নানান হাবিজাবি!

--হুমম, তারপর?

--আরেকবার 'হুমম, তারপর' বললে তোমার খবর করে দেব!
--হা হা হা--   হাসতে না গিয়েও শেষে হেসে ফেলে সালাম। রাহাত বারান্দার সেই অস্পষ্ট আলো-আঁধারীতে তার বাবার হাসিমুখটা দেখে মুগ্ধ হয়ে যায়।নিজের মনে মনেই বলে- বাবা, তুমি কি জানো হাসলে তোমাকে কী অসাধারণ লাগে!!!

--তো, বল, তারপর কী হল
যাক, বাবা তুই-তোকারীতে ফেরৎ এসেছে। খানিকটা স্বস্তি নিয়ে রাহাত আবার শুরু করে

--মুস্কিলটা হল এই জায়গাতে। আমার একটা অংশ চাইছে সানি কে আপন করে নিতে আর আরেকটা অংশ--
এইটুকু বলে চুপ করে রাহাত।
--আরেকটা অংশ কী বলছে? সালাম শান্ত স্বরে জিজ্ঞেস করে।
--বলছে--বলছে--মায়ের মত বিহেভ না করতে!

এই মুহূর্তে ঘরে বাজ পড়লেও হয়ত সালাম এতটা চমকাতো না। খানিকটা তোতলাতে তোতলাতে সে বলল, এর সাথে তোর মায়ে'র সম্পর্ক কী?

--সম্পর্ক আছে। ধীর শান্ত গলায় রাহাত বলে।
--তুমি যতই ঢাকার চেষ্টা কর না কেন বাবা, আমি জানি আসলে কী হয়েছিল। আমি জানি কিভাবে মা তোমাকে ছেড়ে ঐ লোকটার সাথে চলে গিয়েছিল স্রেফ কিছু টাকার জন্যে আর বিদেশী জীবনের আরামের লোভে।

সালামের মনে হয় চিৎকার করে সে রাহাত কে থামিয়ে দেয়। চিৎকার করে বলে, না এইসব মিথ্যে কথা। তোর মা এইজন্যে আমাকে ছেড়ে যায় নি। কিন্তু কেন জানি তার খুব ক্লান্ত লাগে।

---ব্যাপারটা আসলে তুই যেভাবে বলছিস, ঠিক সে রকম না। আসলে হয়েছিল কি জানিস?--আসলে--
--বা'জান আসলে কী হয়েছিল সেটা নিয়ে আমার কোন মাথা ব্যথা নাই। আমি শুধু জানি তুমি কিভাবে আমাকে বড় করেছ। এইটাই যথেষ্ট। আর মায়ের ঘটনাটার সাথে মিলের কথা বলছিলে বাবা? মিল আছে। আমি যদি আজ সানি-র কথায় সাড়া দিই,সানি হয়ত তার বিয়ে ভেঙ্গে দেবে। তার প্রেমিক সম্পর্কে যতটুকু জেনেছি--ভদ্রলোক অত্যন্ত আত্ম-সম্মান সচেতন লোক। তিনি কষ্ট পেলেও এইটা নিয়ে কোন নোংরামী করবেন না। তার ফ্যামিলিতে হয়ত কাউ-কাউ হবে কিছুদিন---কিন্তু আল্টিমেটলি তারাও মেনে নেবেন, আই এম শিউর!

সালাম অবাক বিস্ময়ে রাহাতের কথা শুনতে থাকে। কেন জানি রাহাতকে এই মুহূর্তে ভীষন অচেনা লাগছে সালামের কাছে।

--কিন্তু আমার দ্বিধাটা অন্য জায়গায়, বাবা। রাহাত বলে চলে,
--আমার নিজেকে কেবলি সেই লোকটার মত লাগছে যে সব জেনেশুনেও মা-কে তোমার কাছ থেকে নিয়ে গিয়েছিল--সে চাইলেই মা কে নিষেধ করতে পারত। মা নাহয় পাগল হয়েছিল। তাই বলে লোকটাকেও কী--

--দ্যাটস ইনাফ রাহাত। থিংস আর নট এজ সিম্পল এজ দে সিম!  মানুষের  সম্পর্ক খুব জটিল প্রক্রিয়ায় কাজ করে। এইটা কোন লিনিয়ার প্রসেস না। ঐ লোকটার দোষ নেই সেটা বলছি না, কিন্তু শুধু তাকে, বা তোর মা কে দোষী করা ঠিক না। হয়ত এতে আমারো কোন দোষ ছিল--

--না, তোমার দোষ ছিল না। রাহাত জোর দিয়ে বলে।
--ইউ ডোন্ট নো দ্যাট। এনি ওয়ে। আমি এই নিয়ে আর কথা বলতে চাইছি না।
--কিন্তু আমি কী করব, বাবা? কী করা উচিত আমার?

এই প্রথম পাঁচফুট আট ইঞ্চি রাহাত কে চট করে ক্লাস ফাইভের ছোট্ট রাহাতে বদলে যেতে দেখল। অবিকল সেই অসহায়তা আর বিপন্নতা তার চোখে।


-ট্রাস্ট ইয়োর হার্ট,সন, ট্রাস্ট ইয়োর হার্ট।
সালাম রাহাতের মাথার চুল এলোমেলো করে দিয়ে আলতো করে একটা চুমু খায় কপালে। বিড়বিড় করে বলে,হৃদয়কে বিশ্বাস করলে ঠকবি অনেক, কষ্ট পাবি তারচেয়েও বেশি। কিন্তু ভুল হোক, শুদ্ধ হোক,মাথা খরচ করে হিসেব করে ভাল থাকার চেয়ে হৃদয়ের কথা শুনে দুঃখে থাকা অনেক ভাল।
গুড নাইট,সন।

বারান্দা ছেড়ে যখন ঘরে ফিরছে সালাম, তখন রাত গভীর হয়েছে শহরে বুকে। হৃদয় যাতনায় বিপন্ন কিছু মানুষ ছাড়া আর কেউ জেগে নেই এই রাতে।






















আমার বাড়ি ছোট্ট বাড়ি--

বাচ্চাদের সাথে আমার কেন জানি কখনোই খাতির হয় না।

কথাটা পুরোপুরি ঠিক না---বরং বলা ভাল, 'খাতির হত না'। অতীত কালে। আমি দেখতাম লোকজন কত অবলীলায় বাচ্চাদের সাথে বন্ধুত্ব করে ফেলে। মিনিটের মাঝে বাচ্চারা তাদের ফ্যান হয়ে যায়। দেখা হবার পাঁচ মিনিটের মাথায় বাচ্চারা তাদের কোলে-কাঁখে-ঘাড়ে চড়ে বসে। ঈর্ষায় আমার চোখ ছোট ছোট হয়ে আসত। উদাস ভঙ্গীতে জানালা দিয়ে বাইরে তাকাতে তাকাতে নিজেকে বলতাম--'দেখিস, একদিন আমরাও--'

আমার এই অবস্থার উন্নতির কোন সম্ভাবনা দেখছিলাম না। শেষে এমন মনে হতে লাগল---আমার নিজের বাচ্চারা যদি দেখা যায় আমাকে পছন্দ করছে না--তখন?? এই ভয়ে বিয়ে-শাদীর প্ল্যান বাদ দিয়ে দিলাম (আরো অনেক কারণের মাঝে এইটা একটা)।

আমার ভাগ্যাকাশে দুর্যোগের মেঘ কেটে গিয়ে সূর্যের দেখা মিলল হঠাৎ করেই।

ডেলাওয়ারে আসার ক'বছর পর সাইফ-প্রজাপতি দম্পতির সাথে পরিচয় হল। দেখলাম তাদের একটা শিশু কন্যা আছে। আমি মনে মনে প্রমাদ গুনলাম। এইরে, এই বাচ্চাও তো দেখা যাবে আমাকে পছন্দ করছে না। অবশ্য ততদিনে বাচ্চাদের কাছ থেকে 'প্রত্যাখ্যাত' হতে হতে এক রকমের সয়ে গেছিলাম। সাইফের মেয়েটা দেখা গেল প্রথম দিনেই আমার কোলে চড়ে বসল। আমি একটু আমতা আমতা করতে লাগলাম। বাচ্চা একটা কোলে এসে বসলে তাকে কী বলা উচিত? কী নিয়ে আলাপ শুরু করা উচিত??
আজকের আবহাওয়া কেমন?
আপনাদের ঐ দিকে এই বৎসর ধান  কেমন হয়েছে ?
ওবামার ইকোনোমিক প্ল্যানটা কতটুকু ফলপ্রসু হবে??
 নাকি, তার নাম জিজ্ঞেস করব শুরুতে? অনেক ভাবনা চিন্তা করে ওর নাম জিজ্ঞেস করাই মনস্থ করলাম। কিন্তু ততখনে সে কোল থেকে নেমে দৌড় দিয়েছে। কেউ কি খেয়াল করে দেখেছেন--পৃথিবীর সব চাইতে ব্যস্ত-সমস্ত লোক আসলে বাচ্চারা! সব সময়ে কিছু না কিছু তারা করছে। নেহায়েত কোন কিছু না পাওয়া গেলে দেখা যাবে ঘরের মধ্যে টেবিলের চার পাশে দৌড়াচ্ছে। আমি এখন পর্যন্ত কোন বাচ্চাকে গম্ভীর হয়ে বসে থাকতে দেখলাম না।

যাই হোক, সাইফ কে জিজ্ঞেস করলাম তার মেয়ের নাম কী? সাইফ বলল, ওর নাম সামারা। নামটা শুনেই একটু চেনা চেনা মনে হচ্ছিল। সেইটা খেয়াল করে সাইফ বলল, বস আপ্নে তো Ring ছবিটা দেখসেন, তাই না? সামারা ছিল--সাইফের আর বলতে হল না। মনে পড়ে গেল সবকিছু। ঐখানে মেয়েটার নাম ছিল সামারা। আমার দেখা দুর্দান্ত রকমের ভয়াবহ কিছু হরর ছবির মাঝে 'রিং' ছবিটা অন্যতম। যাই হোক, হরর মুভি থেকে মেয়ের নাম বাছাই করার কী যৌক্তিক কারণ আছে, দেশে কি নামের অভাব পড়েছিল---এ জাতীয় জন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে সাইফের সাথে বেশ লম্বা চওড়া এক তর্কের প্রস্তুতি নিয়ে নিলাম। সময় সুযোগ বুঝে ব্যাটাকে ক্যাঁক করে ধরে ফেলতে হবে।

সে সুযোগ আর হয়ে উঠে না। এর মাঝে সাইফরা দেখা গেল, আমি যে এপার্ট্মেন্ট কমপ্লেক্সে থাকতাম সেইখানে উঠে আসল। দিনের মাঝে দশ বিশবার করে দেখা হতে লাগল। আমি তখন ধীরে ধীরে রান্নার পাট চুকিয়ে ফেলেছি। আমার প্ল্যানটা ছিল এই রকম--- ধাপে ধাপে প্রথমে রান্না-বান্না বাদ, তারপর খাওয়া-দাওয়া বাদ। এবং এইভাবে এক সময় নিজেকে খাদ্যে 'স্বয়ং-সম্পূর্ণ' করে ফেলার প্ল্যান ছিল। বিনা খাদ্য গ্রহন করেও বেঁচে থাকা সম্ভব---সেইটা প্রমাণের একটা মাস্টার প্ল্যান আমার হাতে ছিল। সাইফ দেখা গেল আমার সেই মহৎ প্ল্যানটা ভন্ডুল করার জন্যে উঠে পড়ে লেগেছে। প্রতিদিন ফোন করে। বলে, কী করেন মিয়া, আইসা পড়েন---আজ 'অমুক-তমুক' রানছি চলে আসেন। প্রথমে কয়েকবার 'খেয়ে ফেলেছি' বলে পাশ কাটিয়েছিলাম। কিন্তু কীভাবে জানি সাইফ বের করে ফেলল কথাটা সব সময়ে সত্যি না। নিরূপায় হয়ে গভীর রাত পর্যন্ত অফিসে কাটানো শুরু করলাম।

আমার এত সাবধানতার পরও দেখা গেল সপ্তাহে দু' তিনবার করে তাদের বাসায় খাওয়া-দাওয়া করছি। সাইফ হাতে কিল মেরে বলল, দাঁড়ান বস, চাকরী একটা পাইয়া লই---আপ্নের রোজ রাইতের খাওয়া এইখানে হবে। আমি মনে মনে প্রমাদ গুনলাম। সমস্যা হল, সাইফের বউ প্রজাপতি অসাধারণ রাঁধে। ব্যাপারটা কী রকম একটু বুঝিয়ে বলি। আয়োজন করে ভাল রান্না অনেকেই করতে পারে। কিন্তু আমার দেখা দুর্ধর্ষ রাঁধুনীদের মাঝে প্রজাপতি একজন---যার কোন আয়োজনের প্রয়োজন নেই। একেবারে সাধারণ চাল-ডাল-শাকসব্জি  দিয়ে চট করে সে দেবভোগ্য খাবার তৈরি করে ফেলতে পারে। তার রান্নার গুনগত উৎকর্ষের কারণে আমার আপত্তি গুলো ক্রমেই দুর্বল হয়ে যাচ্ছিল। তাতে আবার গুরুত্বপূর্ণ ইন্ধন যোগাচ্ছিল তাদের মেয়ে--সামারা। ততদিনে সামারার সাথে আমার 'মোটামুটি' টাইপের একটা বন্ধুত্ব হয়েছে। আমি আসলেই সে দরজা খুলে দিতে আসে। সে বাসার যে খানেই থাকুক না কেন, আমি বেল বাজিয়েছি আর সে দৌড়াতে দৌড়াতে এসে দরজা খুলেনি---এমন ঘটনা বিরল। মাঝে মধ্যে তার মা-বাবা ভুল করে দরজা খুলে ফেললে মাটিতে শুয়ে পড়ে কান্না কাটি। তখন কান্না থামানোর জন্য আমি আবার ঘরের বাইরে যেতাম। সেখান থেকে বেল টিপতাম। এক হাতে চোখ মুছতে মুছতে সামারা হাসিমুখে দরজা খুলে দিত। আমার এই নশ্বর জীবনে এতবড় সম্মান আর কেউ কখনো দেখায় নি। শেষের দিকে এমন হল---আমি সিঁড়ি বেয়ে উঠছি, সেই আওয়াজ শুনে সে এসে দরজা খুলে দিত। এক বিচিত্র অনুভূতি আমার মাঝে খেলা করত। অনেক পরে বুঝতে পারলাম--একেই 'স্নেহ' বলে।

এরমধ্যে একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আমাদের সামনে চলে আসল।
আমাকে কী নামে ডাকা হবে? প্রজাপতি এবং সাইফ কোমর-বেঁধে লেগে পড়ল। সামারাকে অষ্টপ্রহর জপানো হল, আমি 'তারেক আঙ্কেল'। পরের দিন দরজায় বেল টিপেছি। সামারা দৌড়ে এসে দরজা খুলে মুখ ভর্তি হাসি নিয়ে বললঃ

'থায়েক ভাই'!!!---

এরচেয়ে মধুরতর শব্দ আমি আর কখনো শুনেছি বলে মনে পড়ে না। তার বাবা-মা হৈ হৈ করে তেড়ে আসল। আমি খুনীর মত মুখ চোখ করে বললাম---কেউ যদি সামারেকে দিয়ে আমার অন্য কোন নাম শেখানোর চেষ্টা করে, তার কপালে বহুৎ খারাপি আছে। আমার সেই হুমকির কারণেই কিনা জানিনা---আমি পাকাপোক্তভাবে 'থায়েক ভাই' হয়ে গেলাম।

সেই থেকে শুরু।

এখনো আমি তার 'থায়েক ভাই'। আমার যত খারাপ দিনই যাক না কেন---সামারার ঐ একটা ডাক আমাকে পুনরুজ্জীবিত করে দেয়। আমার সকল দুর্যোগে, সকল ঝড়-ঝঞ্ঝায় আমার একমাত্র বাতিঘর সামারা।

সামারা ইদানিং গান গাওয়া শুরু করেছে। বাংলা গান। ছোটদের মুখে যাই-ই শোনা যায় না কেন---সে অমৃতবাণীর মত শোনায়। তার উপরে যদি সে বাচ্চা লর্ড ক্লাইভের উচ্চারণে বাংলা কথা বলে---সেইটার কোন তুলনা হয় না। অনেক আগে মনে আছে---শাবিপ্রবিতে থাকার সময় এলাকার সব বাচ্চাদের নিয়ে একটা গান গাওয়ানোর চেষ্টা করেছিলাম। সেই দঙ্গলে জাফর স্যারের দুই ছেলে-মেয়েও ছিল। তাদের জন্য নির্ধারিত গানটা ছিল--"আমরা সবাই রাজা আমাদেরি রাজার রাজত্বে"। নাবিল আর ইয়েশিম (জাফর স্যারের ছেলে মেয়ে), বাংলাটা তখনও ঠিক কব্জা করে নিতে পারেনি। বেচারারা মাত্র মাস কয়েক হল দেশে এসেছে। ওরা যখন কথা বলে নিজেদের মাঝে--তখন ইংরাজীতে বলে। দেবদূতের মত দুইটি শিশু টুকটুক করে ইংরাজীতে কথা বলছে, আর আমরা হা করে শুনছি--এইটা একটা নিত্য নৈমিত্তিক বিষয় ছিল। যাই হোক, ওদের যখন গান গাওয়ানোর চেষ্টা করা হল, তখন দেখা গেল ওরা লর্ড ক্লাইভের উচ্চারণে গান গাইছে---'আমRa সবাই Raজা আমাদেRi Raজার Raজত্বে"
আহা---সে গান শুনেও আনন্দ!!

আমাদের সামারার অবস্থা ওদের চেয়ে অনেক ভাল বলতে হবে। কিন্তু একটা দেবশিশু গান গাইছে, আমার নিজের মাতৃভাষায়---এরচেয়ে অসাধারণ আর কী হতে পারে? গতকাল সাইফের বাসায় আমরা জড়ো হয়েছিলাম বাংলাদেশের সিরিজ জয় উদযাপন করতে। এক ফাঁকে আমি সামারার কন্ঠে একটা গান রেকর্ড করে নিয়ে আসি। আমার সুপারভাইজার দেশের বাইরে। সুপারভাইজাররা দেশের বাইরে গেলে কেন জানি অমানুষ হয়ে যান। আমার বসও তার ব্যতিক্রম নন। আগামী কাল আমার বেশ বড়সড় একটা রিপোর্ট পাঠানোর কথা। কিন্তু আজ সারাদিন আমি আর কিছুই করিনি। সামারার ঐ গান নিয়ে পড়েছিলাম। অনেকগুলো গানের টুকরো একসাথে করে বসেছি। গানটা ছোটদের হলেও এইটা একটা বিসমপদী তালের গান। বড় মানুষদেরই ঘাম ছুটে যায়। অথচ বাচ্চাটা কী অবলীলায়ই না গানটা গেয়েছে!! এবং আনন্দে গেয়েছে। একটা ছোট্ট মানুষ তার ছোট্ট বুকটা ভরে, মনে আনন্দ পুরে এই গানটা গেয়েছে।

গানটা শুনুন এবং আমাকে ঈর্ষা করুণ! এই অপ্সরা আমাকে 'থায়েক ভাই' নামে ডাকে---আমার আর কী চাই এই পৃথিবীতে।


কন্ঠঃ
সামারা
যন্ত্রানুষঙ্গঃ অনিকেত






























কারে দেখাব মনে দুঃখ--

বছর পনেরো আগের কথা।

তখন কুমিল্লার একটা প্রত্যন্ত গ্রামে চাকরী করি।ভাঙ্গাচোরা একটা সরকারী কলেজ। দূর থেকে দেখে বড় জোর হাইস্কুল মনে হয়। সেইখানে পদার্থবিজ্ঞান পড়ানোর অপচেষ্টা করি। ক্লাসে গোটাবিশেক ছাত্র ছাত্রী। তাদের মুখগুলো সব সময়ে আনন্দে উৎসাহে ঝলমল করছে। আমি কেন জানি এইসব দেখে উৎসাহ বোধ করি না খুব একটা। প্রতিদিন সকালে যাই। টিচারদের কমন্স রুমে বসে পত্রিকা পড়ার চেষ্টা করি।  ...বছর পনেরো আগের কথা।

তখন কুমিল্লার একটা প্রত্যন্ত গ্রামে চাকরী করি।ভাঙ্গাচোরা একটা সরকারী কলেজ। দূর থেকে দেখে বড় জোর হাইস্কুল মনে হয়। সেইখানে পদার্থবিজ্ঞান পড়ানোর অপচেষ্টা করি। ক্লাসে গোটাবিশেক ছাত্র ছাত্রী। তাদের মুখগুলো সব সময়ে আনন্দে উৎসাহে ঝলমল করছে। আমি কেন জানি এইসব দেখে উৎসাহ বোধ করি না খুব একটা। প্রতিদিন সকালে যাই। টিচারদের কমন্স রুমে বসে পত্রিকা পড়ার চেষ্টা করি। ঢাকা থেকে আসেন আরো কিছু শিক্ষক। তাদের সাথে মাঝে মধ্যে একটা দু'টো কথাবার্তা। সমাজবিজ্ঞানের শিক্ষক (ভদ্রলোকের নাম ভুলে গেছি--কিন্তু চেহারাটা আজও পরিষ্কার মনে আছে--দশাসই চেহারা, তার সাথে মানান সই কন্ঠ) কমন রুমে ঢুকেই দরাজ গলায় ডেকে উঠতেন, 'কি খবর তারেক আজিজ সাহেব? আজ মন ভাল তো?' তারপর উত্তরের অপেক্ষা না করেই বেয়ারা আরব আলীকে হাঁক দিতেন,

'আরব আলী, প্যান্টটা একটু ছেড়ে দাও দেখি--'

প্রথম যেদিন শুনেছিলাম, সেদিন বিষম-টিষম খেয়ে নাজেহাল অবস্থা। ইংরেজীর হায়দর ভাই পাশে বসে ছিলেন। চোখ টিপে জানালেন এখানের অনেকেই 'প' আর 'ফ'  এর মাঝে তেমন একটা তফাৎ করতে পারেন না। আমাদের একজন ম্যাডাম ছিলেন যার নাম ছিল ফারজানা। ভীষন মিশুকে একজন মানুষ। উনিও খুব সম্ভবত সমাজবিজ্ঞানেরই শিক্ষিকা হবেন। তো আমাদের সেই প্রথমোক্ত ভদ্রলোক একদিন প্রিন্সিপাল স্যারের রুম থেকে বেরিয়ে এসে আরব আলীকে জানালেন,

'আরব আলী, তুমি একটু পারজানা ম্যাডাম কে স্যারের রুমে ফাটিয়ে দাও তো--'

হাসি থামানোর জন্যে সেদিন আমাকে কমন রুমের বাথরুমে আত্মগোপন করতে হয়েছিল। আরো ছিলেন অংকের মান্নান স্যার। সর্বদা পান ঠাসা মুখ। পাশে দিয়ে গেলে জর্দার ভুর ভুর গন্ধ আসত। দুপুরের দিকে সব ক্লাস শেষ হলে একটা খালি ক্লাসে বসে তিনি ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে টিউশনি করতেন। তখন পাশ দিয়ে হেঁটে গেলে শোনা যেত স্যার রোষকষায়িত লোচনে ছাত্র-ছাত্রীদের বোঝানোর চেষ্টা করছেন,

'বুইঝলা কিনা, AB আর CD পরস্পরকে E বিন্দুতে ছেদ কইরেসে--'

'E বিন্দুতে ছেদ' বলার সময়ে স্যার প্রয়োজনের চেয়ে একটু বেশি জোর দিতেন। ঐসময় স্যারের ভাঁটার আগুনের মত জ্বলজ্বলে চোখ, মুখের কষ বেয়ে নেমে আসা রক্তরাঙা তাম্বুলরস আর মাথার আলু-থালু কেশ---সবমিলিয়ে কেমন যেন একটা ভ্যাম্পায়ারের মত দেখাত। আড়চোখে চেয়ে দেখেছি ওই সময়ে ছাত্র-ছাত্রীরাও ভয়ে খানিকটা শিউরে উঠত। অবসর সময়ে আমরা সবাই মান্নান স্যারের মত চোখ পাকিয়ে 'AB আর CD পরস্পরকে E বিন্দুতে --' প্র্যাক্টিস করতাম।

দুপুরে বুয়ার রান্না করা বিস্বাদ ভাত-তরকারী গলাধঃকরণ করা, সন্ধ্যে হয়ে আসলে ইংরাজির হায়দর ভাই, কেমিস্ট্রির বশির ভাই আর অর্থনীতির আরিফ ভাই কে নিয়ে গ্রামের রাস্তায় হাঁটতে বেরুনো---এই ছিল আমার রুটিন! সারা গ্রামে একটা মাত্রই চারতলা বিল্ডিং। ছাত্রদের হোস্টেল হিসেবে বানানো হয়েছিল। সেখানে আমাদের এই চার ব্যাচেলর শিক্ষককে থাকতে দেয়া হয়েছিল।

সেই গ্রামে আমি দীর্ঘ দুই বছর ছিলাম। সময় হিসেবে দুই বছর হয়ত খুব একটা বেশি সময় নয়। কিন্তু আমার মনে হত আমি যেন কোন এক অন্ধকার জগতে আটকা পড়ে আছি অনাদিকাল হতে। আমার কোন নিস্তার নেই, কোন উত্তরণ নেই, কোন নির্বাণ নেই। সন্ধ্যার পর সে গ্রামে প্রানস্পন্দন থেমে যেত। তখন মনে হত আমাকে যেন কোন এক তেপান্তরের মাঠে নির্বাসন দেয়া হয়েছে। আশে পাশে কিচ্ছুটি নেই। বিশাল একটা মাঠ, এক পাশে মজা পুকুর, দরমার বেড়া দেয়া স্কুলঘর---আর এদের পেছন থেকে মাঝে মাঝে উঠে আসত এক অলৌকিক চাঁদ। মাঝে মাঝে রাতে যখন হাঁটতে বেরুতাম-- তীব্র এক বিষাদ  আমাকে গ্রাস করে নিত। একা একা হাঁটতাম গ্রামে পথে পথে। তখন আবার সন্ধ্যা হলেই কারেন্ট চলে যেত। কোন কোন রাতে কারেন্ট আসত--কোন কোন রাতে আসতই না।  অন্ধকার সে রাতগুলোয় বিশাল স্কুল মাঠে চেয়ার পেতে বসে থাকতাম আমরা চারটি প্রানী। বশির ভাই প্রবল বিক্রমে ঘন্টাখানেক প্রিন্সিপাল স্যারের বদনাম করে শেষে চুপ করে যেতেন।

কেউ কোন কথা না বলে বসে রইতাম ঘন্টার পর ঘন্টা। সেইসব আলোহীন প্রাণহীন রাতে মাঝে মাঝে কানে ভেসে আসত অপার্থিব কিছু সুর। আমাদেরই কলেজের একটা ছেলে। বখাটে হিসেবে তার বেশ নামডাক। প্রতিবার এইচ এস সি পরীক্ষার সময় নকল করে ধরা পড়ত। ফেল করত। মাঝে মাঝে আমাদের 'সাইজ' করে দেবার হুমকি ধামকি দিত। আবার গ্রামের হাটে দেখা হলে রিক্সা থেকে লাফ দিয়ে নেমে রিক্সাটা দিয়ে দিত---শতবার আপত্তি জানানো সত্ত্বেও। কোনবার তাকে বিশ্বাস করানো যায়নি যে আমরা স্রেফ হাঁটতে বেরিয়েছি---রিক্সার দরকার নেই।

সেই ছেলেটা জোছনা রাতে মাতাল হয়ে গান ধরত। ঘাড়ে-গর্দানে চেহারা, মুখে সব সময় একটা ক্রুর হাসি ঝুলছে---সেই ছেলেটা জোছনা রাতে মাতাল হত। যার হাঁকেডাকে কলেজের অধ্যক্ষ থেকে বেয়ারা অবধি সবাই তটস্থ রইত---সেই ছেলে জোছনা রাতে গান ধরত। রুপালী আলোয় ভেসে যাওয়া চরাচর, মজা পুকুরে থির হয়ে ভাসা চাঁদ তার বুক ভেঙ্গে বের করে নিয়ে আসত এক বড় দুঃখী মানুষ কে। সে দুঃখী ছেলে গাইত

'কারে দেখাব মনে দুঃখ আমি বুক চিরিয়া
অন্তরে তুষেরি অনল জ্বলে গৈয়া গৈয়া--'

সিলেটের ভাটি অঞ্চলের রাধারমন দত্ত সেই সব অলৌকিক রাতে তার কন্ঠে ভর করতেন। আমরা চারটি প্রানী নিস্তব্ধ হয়ে শুনতাম---দিনের বেলার দানব তার সকল অস্ত্র চাঁদের আলোয় বিসর্জন দিয়ে শোনাচ্ছে কোন এক হৃদয়হীনার কথা---যার কাছে সে নিহত হয়েছে বারংবার---

আমি আজ সে গ্রাম থেকে অনেক দূরে।
সেই মাঠ, সেই মজা পুকুর আমি দেখিনা কতদিন---
হায়দর ভাই, বশির ভাই, আরিফ ভাই, আমি---আমরা সকলেই ছিটকে গেছি একেক দিকে সময়ের টানে--
সময় হয়ত বদলে দিয়েছে আমার সেই ছোট্ট গ্রামটাকেও। হয়ত এখন আর সেই মাঠ নেই, নেই সে পুকুর, নেই প্রিন্সিপাল স্যারের রুমের পাশের সে কাঁঠাল চাঁপার গাছ---
এক সময় যে জায়গাটাকে মনে হত দুর্বিসহ শ্বাসরুদ্ধকর কয়েদখানা, আজ শুধু সেই জায়গাটা এক পলক দেখার জন্যে, শুধু একবার সেই মাঠে জোছনা রাতে ফেরার জন্যে বিকিয়ে দিতে রাজী আমার আত্মা--ঈশ্বর কিংবা শয়তানের হাতে--

আজ আমি পৃথিবীর উলটো পাশে এক নাম-না-জানা শহরে হেঁটে বেড়াই। প্রতিদিন কিছু মুখস্থ মানুষ দেখি। পনেরো বছর আগের যে জীবন আমার কাছ থেকে পালিয়ে গেছে অচিনলোকে তাকে মনে প্রাণে ভুলে যেতে চাই।

কেবল মাঝে মাঝে আকাশ জুড়ে ওঠে এক বিশাল রুপোর থালা---আর আচমকা আমার চারপাশ বদলে যায়। আমার ঘরের বাতি নিভিয়ে জানালা খুলে দিই। জানালা দিয়ে ঘরে নরম পায়ে আসে চাঁদের আলো----তার সাথে আসে কিছু কাঠাল চাঁপার গন্ধ, এক বিশাল মাঠ, জোছনার আলোয় প্লাবিত চরাচর-- আর একটা মাতাল কন্ঠ---

আমার তখন নিশ্বাস ফেলতেও ভয় করে--যদি ভেঙ্গে যায় এই স্বপ্ন আমার--


রাধারমনের এই গানটা আমার সেই হারিয়ে যাওয়া সময়গুলোর জন্যে, সেই মাতাল ছেলেটার জন্যে আর সেইসব অলৌকিক রাতগুলোর জন্যে--

কথা- রাধারমন দত্ত
সুর- প্রচলিত
সঙ্গীতায়োজন, কন্ঠঃ অনিকেত







আমার রুবি রায়

আমার ছোটবেলাটা কেটেছিল এই পৃথিবীর সবচাইতে সুন্দর বাড়িটায়!

সিলেটের এম সি কলেজের প্রিন্সিপালের বাংলো আমার দেখা এই পৃথিবীর সবচাইতে চমৎকার বাড়ি।
ছোট্ট একটা টিলার উপর একটা বিশাল একতলা বাড়ি। বাড়িটা ঘিরে কত কত নাম-না-জানা গাছের সারি। একটা ছোট্ট পাকদন্ডী টিলাটার গা বেয়ে ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে উঠে গেছে বাড়িটার দিকে। নিশুত রাতে সেই পাকদন্ডী বেয়ে হাঁটতে বেরুলে মাঝে মাঝেই গা শিরশির করে উঠত। দারুণ গ্রীষ্মের দুপুরে বাড়িটার প্রশস্ত বারান্দায় অলস দুপুর ঘুমুতে আসত। বারান্দা থেকে হাত-বাড়ানো দূরে একটা পেয়ারা গাছ। সেটা ছাড়িয়ে গেলে কেবল ফুলের বাগান। কত কত ফুল! সন্ধ্যে বেলাটা ছিল আমার সবচাইতে প্রিয়। পশ্চিমের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে সূর্যদেবকে বিদায় জানাতাম। দেখতাম সারা দিনের ক্লান্তি সাথে নিয়ে সূর্য দূরের ঐ মাঠটার পেছনের নীল কুয়াশার চাদরে ডুবে যাচ্ছেন। শীতের দিনের সকাল-বিকেল দুইটাই ছিল অসাধারণ। সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে পড়তে বসার আগে এক ছুটে বাড়ির বাইরে যাওয়া। বারান্দায় স্যান্ডেল রেখে এসে খালি পায়ে ভোরের শিশির ভেজা ঘাসে পা রাখা। মনে হত ঘাসেরা যেন ছোট ছোট হাত বাড়িয়ে আলতো করে জড়িয়ে ধরছে আমার পায়ের পাতাটাকে পরম মমতায়। বিকেলে দেখতাম পাহাড়ের চূড়া থেকে সূর্যের অস্তাগমন। পাহাড়ের চূড়া থেকে যে সূর্যাস্ত না দেখেছে--তাকে বলে বোঝানো যাবে না সেই অপার্থিব সৌন্দর্যের কথা।

সেই বাসায় যখন আমি আমার স্বপ্নের মত দিন কাটাচ্ছি--তখন একদিন আমার 'সুখের ঘর' 'অনলে পুড়িয়া গেল'। একটু পরিষ্কার করি বিষয়টা। মহানায়ক উত্তমকুমারের তিরোধান উপলক্ষে একটা ক্যাসেট বেরিয়েছে তখন। নাম খুব সম্ভবত 'মহানায়ক উত্তমকুমার স্মরণে'। উত্তম অভিনীত সব ছবির উত্তম-মধ্যম-অধম গান আর কিছু কিছু সংলাপ নিয়েই ক্যাসেটটা। অতি উত্তম! কিন্তু আমার সুখের ঘরে আগুন লাগল কী করে? আগুনটা লাগল ক্যাসেটের 'এ' পিঠের শেষে এসে পিঠ ঠেকতেই! যারা আমার মত ক্যাসেট শুনে শুনে বড় হয়েছেন (এখনকার পুলাপানরা তো কথায় কথায় সিডি/এম্পি৩ প্লেয়ার ঝেড়ে দেয়) তারা জানেন প্রায় সব ক্যাসেটের শেষের দিকে একেবারে অবধারিত ভাবে কিছু 'ফিলার' মিউজিক দেয়া থাকত। বড়জোর দুই-তিন মিনিটের। উত্তমকুমারের সেই ক্যাসেটের 'এ' পিঠের শেষে এমনি ছিল একটা দুই মিনিটের মিউজিক। যন্ত্র সঙ্গীত। আমার সুখের ঘরে আগুন ফুঁকে দিল ঐ দুই মিনিটের গানটাই। প্রথমবার শুনেই ধরাশায়ী। দ্বিতীয়বার শুনে প্রায় পঞ্চত্বপ্রাপ্তিযোগ হবার অবস্থা। যারা কিন্তু দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ভুগছেন---তাদের কাছে পরিষ্কার করি, গানটা আসলেই আমার 'প্রাণ' কেড়ে নিয়েছিল। মুস্কিল হল এইটা একটা মিউজিক ট্র্যাক। আসল গানটা নেই। মনে একটা ক্ষীন আশার আলো জ্বলে উঠল। হয়ত অপর পিঠে গানটা থাকতে পারে!! হ্যাঁ তেমন কপাল করে এসেছি কি না আমি!! ওই ক্যাসেটের ফিতার প্রতি সেন্টিমিটার আঁতিপাতি করে খুঁজেও এই গান পাওয়া গেল না। সবকিছু ছাপিয়ে রাগটা গিয়ে পড়ল বাবার উপরে। ক্যাসেটটা তিনিই এনেছিলেন কিনা। আমার মনে হতে লাগল--গত সপ্তাহে ব্যাডমিন্টনে তাকে হারিয়ে দেয়ায় এই শাস্তি তিনি আমাকে দিচ্ছেন। অবশ্য ভদ্রলোক ঘোরতর আপত্তি জানালেন আমার এহেন হাইপোথিসিসে। আমার রাগটা আরো বাড়ল যখন বাবা বললেন যে, এই গানটা আসলে তিনি শুনেছেন----কিন্তু কথাটা মনে করতে পারছেন না। এইদিকে দিনকে দিন আমার অবস্থা খারাপ হতে লাগল। সারা ক্যাসেট বাদ দিয়ে কেবল ঐ শেষের দুই মিনিট শুনি। আহা, আহা, কী যে চমৎকার সুর! সারাদিন গানটা গুনগুন করি। মাঝে মাঝে নিজের বানানো কথা বসাই, সেইটে শুনেই উলটো নিজেই নিজেকে শাসাই---আরেকবার যদি এমন করেছিস তো-----!!!

আমার পুড়ন্ত ঘরে ঝরঝর করে আগুন নেভানো বৃষ্টির পানি পড়ল--- এক বৃষ্টির দিনে!
ইস্কুল থেকে ফিরছিলাম। পথে আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি নামল। রিকশাওয়ালা বলল সে নাকি কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। একটু বৃষ্টি ধরে এলে যাওয়া যাবেখন। আমরা আশ্রয় নিলাম এক বইয়ের দোকানে। কিশোর ভারতীর নতুন সংখ্যা এসেছে কিনা সেইটার খোঁজ নিতে যাব---এমন সময় শুনলাম রেডিওতে বেজে উঠল সেই সর্বনেশে গান! আমার ঘরপোড়া গান! এবং আবারো কেবলি মিউজিক!! আমি হয়ত বেশ লম্বাচওড়া একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়েছিলাম যেটা শুনে দোকানের মালিক সপ্রশ্নে তাকিয়ে রইলেন আমার দিকে। বললাম, এই গানটার কথা খুঁজছি আজ হাজার বছর হয়। আমার স্কুল ইউমিফর্মের দিকে ভ্রুঁ কুঁচকে তাকিয়ে হাজার বছরের হিসেবটা ঠিক মেলাতে না পেরে ভদ্রলোক যেন আনমনেই বললেন---ফুঃ, এইটা এত খুঁজতে হয়? এইটাতো সবাই জানে---মনে পড়ে রুবি রায়!

বৃষ্টি ধরে এল।
রিকশাওয়ালা তাগাদা দিল।
কিছু কাস্টমার মার মার কাট কাট করে তেড়ে এল।
কিন্তু আমি দোকানদারকে কেবল একই প্রশ্ন করে যাচ্ছিলাম---আপনি নিশ্চিত তো? আপনি আসলেই জানেন তো? সত্যি বলছেন তো???
বহুদিন পর পাহাড় বেয়ে বাসায় ফেরাটা আমার কাছে ক্লান্তিকর লাগল না।

পরের সপ্তাহটা খুব ব্যস্ততায় কাটল। সিলেটের সব ক্যাসেটের দোকানে ঘোরাঘুরি করা হল। নানান দোকান থেকে যাচাই বাছাই করে করে গানটির আসল পরিচয় নিরূপন করা হল। জানলাম আসলে গানটির গায়ক রাহুল দেব বর্মণ। শুধু তাই নয়--গানটির একটি হিন্দী ভার্সন আছে---মেরি ভিগি ভিগি সি। সেটা গেয়েছেন কিশোর কুমার--আমার ছেলেবেলার হিরো! রাহুলের গানেরও ভক্ত ছিলাম আমি। তার 'যেতে যেতে পথে হল দেরী' গানটা যে কতবার করে শোনা---সেটার ইয়ত্তা নেই। কিঞ্চিত অভিমানও হল রাহুলের উপর। ব্যাটা, এইটা যে তোমার গান সেটা আগে বলে দিলে কী এমন ক্ষতি ছিল? পরে নিজেই নিজেকে সান্ত্বনা দিলাম এই ভেবে যে রাহুল দেবের সাথে আসলে ঠিক নিয়মিত যোগাযোগ নেই আমার---ইন ফ্যাক্ট রাহুল দেবের সাথে ক্যাসেটের মলাটে, পত্রিকার পাতায় দেখা হয়েছে। এই পর্যন্তই। এইসব ভেবেচিন্তে শেষে রাহুলকে ক্ষমা করে দেয়াটাই মনস্থ করলাম। ক্ষমাই মাহুতের লক্ষণ!!

যাই হোক, গানটা (এইবার বাণী সমেত) বগলদাবা করে বাড়ি ফিরলাম। ক্যাসেট প্লেয়ারের ভেতর থেকে হাওয়ায় উড়ে গেলেন উত্তমকুমার---এন্টার দ্য রাহুল দেব!

হা হতোস্মি!!

একি শুনি দাসী মন্থরার ---থুড়ি--রাহুলের মুখে! যে গানটার সুর এতদিন জানা ছিল---জানা ছিল না কেবল কথা। যে কথার লাগিয়া আমার বুকে বাজিয়া ছিল এত ব্যথা---সেই কথার এই হাল?? কে না কে রুবি রায় আর তাকে নিয়ে রাহুল দেব কান্নাকাটি করছেন! তারচেয়ে বড় কথা---গানটার মিউজিক কম্পজিশান উত্তমকুমারের ক্যাসেটে শোনা কম্পোজিশানের চেয়ে আলাদা! আমার 'অতি উন্নত' মস্তিষ্ক অচিরেই বের করে ফেলল কারণটা---খুব সম্ভবত এইটা হিন্দী গানটার ট্র্যাক। মোটের উপর সুরের আদলটা ঠিক থাকলেও প্রিল্যুড আর ইন্টারল্যুড একেবারেই আলাদা। যাচ্চলে! এখন আবার হিন্দীটা খুঁজে বের করতে হবে। ততক্ষণে আমার ব্যগ্রতার ঘোড়ার মুখে রাশ পড়েছে। ভাব্লাম হিন্দীটা না পাওয়া পর্যন্ত বরং এইটেই সই। নাই মামার চেয়ে---

সেই ক্লাশ এইট থেকে রুবি রায় আমার সাথে রয়ে গেছেন। পরে এক সময় হিন্দী ভার্সনটা শোনা হয়েছিল। নিঃসন্দেহে কিশোর কুমারের সেরা ক'টি গানের মাঝে একটি ঐ গানটা। কিন্তু কেন জানি রাহুলের ভার্সনটাই সেঁটে রইল গায়ে। আর আজ বুঝি---কারণটা ছিলেন রুবি রায়!

রুবি রায় এক চিরন্তন মানস প্রতিমা। আমাদের সবার ভেতরে একজন রুবি রায় আছেন। আমি চোখ বুঁজে বলে দিতে পারি-- এমন কোন ছেলেকে খুঁজে পাওয়া যাবে না---যে তার কৈশোরে রুবি রায়ের প্রেমে পড়েনি। হয়ত তার নাম রুবি রায় ছিল না--হয়ত নাম ছিল রুম্পা, টুম্পা, স্বর্ণা, ঝর্ণা কিংবা মুক্তি। কিন্তু ভিন্ন নামের আড়ালে তারা সকলেই ছিলেন আসলে রুবি রায়। রুবি রায় আমাদের কৈশোরের অবধারিত প্রেম। রুবি রায় আমাদের অনেকেরই প্রথম প্রেম। অনেকের প্রথম প্রেমের সমাধি। তার সাথে আমাদের পরিচয় হয়েছে কখনো ইস্কুলে বড় বোনের ক্লাসে বোনকে কলম দিতে গিয়ে। কখনো রুবি রায় ছিলেন আমাদের পাশের বাসার সেই ঝলমলে আপু যার হাসিতে কাঁচের শার্সিতে টোল পড়ত। কখনো রুবি রায় ছিলেন কলেজের বড় আপু। কখনো রুবি রায় পাড়ায় রবীন্দ্র জয়ন্তীতে সব বাচ্চাদের রিহার্সেল করানো ব্যস্তবাগীশ এক উচ্ছল ঝর্ণা। রুবি রায় কখনো আমাদের অংক দেখিয়ে দেন। কখনো আমাদের বলেন একটা রিকশা দেকে দিতে।
আমরা কৃতার্থ হই তার সেবায় লাগতে পেরে।
রুবি রায়-রা অনেক সময়েই আমাদের নাম মনে রাখতে পারেন না। কিন্তু আমরা তাদের মনে রাখি আমৃত্যু। আমরা মনে রাখি তার পছন্দের ফুল, মনে রাখি তার পছন্দের সুগন্ধী, মনে রাখি তার হাসির আওয়াজ, চপল ভ্রুঁ ভঙ্গী। এবং বহু পরে দীর্ঘজীবন পথ পাড়ি দিয়ে মোহনার দিকে যখন অগ্রসরমান, তখন হঠাৎ করেই কারো হাসির নুপুর নিক্কণ, কিংবা কারো অর্ধস্ফুরিত ওষ্ঠাধর মনে করিয়ে দেয় জীবনের এক মহার্ঘ্য প্রাপ্তির কথা---রুবি রায়ের সাথে পরিচয় হবার কথা।

আমার রুবি রায়ের সাথে পরিচয় হয়েছিল বেশ দেরীতেই।
তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষের দিকে পড়ছি। এমনি সময় আমাদের নীরস,নির্জীব জীবনে যেন বৃষ্টির শব্দ হয়ে এলেন ---ধরা যাক, তার নাম---রুবি রায়। একেবারেই একজন ক্লাসিক রুবি রায় ইনি। রুবি রায়েদের কিছু লক্ষণবিচার আছেঃ বয়েসে তারা জ্যেষ্ঠ, অধিকাংশ সময়েই তারা থাকেন আমাদের ধরা-ছোঁয়ার বাইরে, তাদের প্রেমে পড়া যায় বিনিময়ে কোনকিছুর প্রত্যাশা না করেই। অধিকাংশ সময়ে তারা জানেনই না যে একজন নীরবে নিভৃতে পূজা করছে তাকে।
ফিরে আসি 'আমার' রুবি রায়ের কাহিনীতে।
রুবি রায়ের সাথে আমার দেখা হল। কথা হল। তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে কী একটা প্রযুক্তি মেলা হবে বা এইরকম কিছু একটা। রুবি রায় এক বিভাগের প্রভাষিকা। তার কিছু সাহায্য দরকার আঁকিবুকি নিয়ে। আমার এক স্যার আমার নাম করাতে হাওয়ায় ভেসে এলেন তিনি আমার সাথে দেখা করতে। তখন আমরা বিশাল ল্যাবরেটরীর মেঝেতে গোল হয়ে বসে নানান প্রজেক্টের কাজ করছি। ঘাড় গুঁজে প্রায় ক্রীতদাসের মত অবস্থা। ল্যাবের দরজাটা হাট করে খোলা। সারাটা ঘরে ঐটেই একমাত্র আলোর উৎস। ঘাড় গুঁজে কাজ করতে করতেই হঠাৎ টের পেলাম ঘরে আলোটা কেমন জানি একটু মৃদু হয়ে এল। সাথে সাথে ভেসে এল এক অপূর্ব সুঘ্রাণ! ঘাড় ঘুরিয়ে তাকানোর আগেই শুনলাম ভীষন মিস্টি একটা কন্ঠ। এবং অস্টম আশ্চর্য রচিত হল তখনই যখন শুনলাম আসলে আমাকেই খোঁজা হচ্ছে। আমি ঠিক জানিনা আমি কী করেছিলাম বা বলেছিলাম। আমি এটাও জানিনা উনি আমাকে কী বলছিলেন। শুধু জানি আমি এমন কিছু প্রত্যক্ষ করছি, এমন কিছু অনুভব করছি যা আগে কখনো করিনি। মনে আছে উনি চলে যাবার পরও অনেকখন ঐখানে স্থানুবৎ হয়ে রয়েছিলাম। হাতের সকল কাজ ফেলে রেখে তার কাজটা করে দিয়েছিলাম। বার বার রুবি রায় এসে ধন্যবাদ জানিয়ে গেছেন। প্রতিটাবার মনে হয়েছে আমি পৃথিবীশ্রেষ্ঠ বীর। হঠাৎ করেই পৃথিবীর সব্বাইকে খুব আপন লাগতে শুরু করল। এমনকি প্রতিদিন সকালে শ্লেষা-জর্জরিত আসুরিক গলায় 'মায়াবন বিহারিনী হরিণী' গাওয়া ফরিদকে পর্যন্ত ক্ষমা করে দিলাম।
আমার এতদিনের আপাত লক্ষ্যবিহীন জীবনে একটা বড় রকমের অদল-বদল হল। যে আমি সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠতে দশটা করে ফেলতাম--সেই আমি নিয়মিত সকাল সাতটায় উঠে পড়ি। সবার আগে গোসল করে সবচাইতে ভাল জামাটা পরে নাস্তা না খেয়েই ছুটি ক্যাম্পাসের পথে। রুবি রায় ক্যম্পাসে আসেন ঠিক সকাল সাড়ে নয়টার বাসে। সারা পৃথিবীর বদলেও আমাকে ঐ সময়টায় ঘরে আটকে রাখা যেত না। ক্যাম্পাসে এসেই ঘড়ি দেখার পালা শুরু হতো। সেই সাথে নানান চিন্তা। গতকাল কোথায় দাঁড়িয়ে ছিলাম? আজ অন্য কোথাও দাঁড়াতে হবে। রোজ এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলে হয়ত সন্দেহ করবেন। আজকে কি সালাম দেব? নাকি গতকালের মত ব্যস্ততার ভান করে হেটে বেরিয়ে যাব? এবং সব প্রশ্নের বড় প্রশ্ন----আজ কি উনি আমার দিকে তাকিয়ে হাসবেন???

জানি, জানি, আপনাদের বড্ড আমোদ হচ্ছে আমার এহেন নাজেহাল নাজুক অবস্থা দেখে।
অনেকের হয়ত বিরক্তি চড়ছে---ভাবছেন এ কী রকম ছ্যাবলামো রে বাবা!
কেউ কেউ হয়ত চোখ কপালে তুলে ভাবছেন, My God...this is creepy!!
কিন্তু আমার তখন এইসব ভাবনার কোন অবকাশই ছিল না। আমার ভাবনার গাছে তখন নিত্য হাওয়া দিয়ে যান রুবি রায়। ঘড়িতে সাড়ে নয়টা বাজে। আর আমার চারদিকের পৃথিবী থমকে দাঁড়ায়। আমি উলটো দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে থাকি। এইটা আমার প্রিয় একটা খেলা। রুবি রায় যখন আসেন, তার সাথে করে আসে এক অপার্থিব সুঘ্রাণ! আজ এতদিন পর মাঝে মাঝে মনে প্রশ্ন জাগে---আমি আসলে তার প্রেমে পড়েছিলাম? নাকি তার সুগন্ধীর? যা হোক, আমার খেলাটা ছিল এই রকম। ডিপার্টমেন্ট বিল্ডিং এর মেইন গেটে আমি উল্টোমুখী হয়ে দাঁড়িয়ে রইতাম। শুধু তাই নয়। চোখ বন্ধ করে। সকাল বেলা ডিপার্টমেন্টের মেইন গেটে চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে থাকাটা যে কী পরিমান রিস্কি সেটা বলে বোঝানো যাবে না। ছাত্রছাত্রীরা অহরহ আসা-যাওয়া করছে। এরমাঝে কল্পনা করুন--আপনি চোখ বন্ধ করে গেটে দাঁড়িয়ে আছেন রাস্তার দিকে পিঠ দিয়ে। পাগল-ছাগল জাতীয় গালিগালাজ সহ্য হয়ে গেছিল দ্রুতই। কিন্তু মুস্কিল হল বন্ধুদের কাছ থেকে ব্যাপারটা চেপে রাখা নিয়ে। একবার যদি টের পায় যে ডাল মে কুছ কালা হ্যায়, তাহলে আমার একেবারেই 'হায় হায়' করে দেবে ওরা। রুবি রায়ের বিষয়টা জানুক বা না জানুক সেটা ভিন্ন প্রসঙ্গ---আমি ভর সকালে মেইনগেটে চোখ বুঁজে দাঁড়িয়ে আছি এইখবরটুকুই আমার জীবনটা ছারখার করে দেবার জন্যে যথেষ্ট।

সবকিছুর পরও আমার কাছে ব্যাপারটা তখন নেশার মত হয়ে গেছে। ততদিনে প্র্যাক্টিস করে করে চোখ পর্যায়ক্রমিক ভাবে খোলা বন্ধ করতে পারি---যাতে লোকের সন্দেহ না হয় (একবার অবশ্য ধরা পড়ে গেসলাম--বন্ধু যখন অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, কি রে এইখানে চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? আমার উত্তর ছিল---আসলে গতরাতে ঘুম হয় নি তো--)। এত কষ্ট (!) সার্থক হয়ে যায়--যখন রুবি রায় আসেন। রুবি রায় উচ্ছল, প্রানবন্ত--কবি নজরুলের ভাষায় 'প্রকৃতির মত সচ্ছল'! তার সাথে কেউ থাকলে তিনি অনবরত কথা বলতে-বলতে-হাসতে-হাসতে আসেন। আমি তার হাসির শব্দ দুই মাইল দূর থেকেই শুনে চিনতে পারি। মজাটা হয় যখন তিনি একলা আসেন। আমি চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে। রুবি রায়ের কোন হাসির শব্দ, কোন কথার আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি না। ঠিক তখনই ঘটে এক অলৌকিক ঘটনা! আমি নিশ্চিত ভাবে টের পাই--বাতাসটা আমার আশে পাশে বদলে যাচ্ছে। একটু একটু করে পালটে যাচ্ছে তার ঘ্রাণ, কেমন যেন হালকা হয়ে যাচ্ছে বুকের ভেতরটা। আমি আমার সকল মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করি। খুব আস্তে করে নিজেকে বিযুক্ত করে ফেলি আশেপাশের পৃথিবীটা থেকে। নিজেকে সন্তর্পনে নিয়ে যাই এমন এক পৃথিবীতে যেখানে শুধু আমি আছি---আর আছেন রুবি রায়---আর এক ব্রহ্মান্ড ভরা সুগন্ধী হাওয়া!

রুবি রায় আমার প্রথম প্রেম না হলেও---অন্যতম প্রেম তো বটেই। রুবি রায় আমার একমাত্র প্রেম--যাকে আমি কখনো মুখ ফুটে বলিনি মনের কথা। রুবি রায়ের কাছে আমার চাওয়ার কিছু ছিলনা। পাওয়ারও ছিলনা কোন প্রত্যাশা। তাকে ভালবাসতাম এক পূজারীর নিষ্ঠা নিয়ে। আমি ভীষন সুখী ছিলাম সেই সময়ে। অথচ সেই সময়ে আমার সুখী থাকার কথা ছিলনা। প্রচন্ড এক কষ্টের সময় পার করছিলাম আমি। রুবি রায়ের কাছে আমার আমৃত্যু ঋণ---তিনি আমাকে বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন। রুবি রায়ের জন্যেই জীবনে প্রথম বারের মত জানতে পেরেছিলাম---পৃথিবীতে কিছু ভালবাসা এখনো লৌকিক চাওয়া-পাওয়ার উর্ধে থাকে।

রুবি রায় কিছুদিন পরে আমাদের ভার্সিটি ছেড়ে চলে যান বিদেশে। উচ্চ শিক্ষালভ্যার্থে। যাবার আগে অবশ্য একটা জরুরি দায়িত্ব পালন করে যেতে ভুলেন নি। আমার বাবার একবন্ধুর মেয়ে ছিলেন তিনি। বিয়ের চিঠি দিতে তিনি নিজেই এসেছিলেন বাসায়।

আমি সেদিন বাসায় ছিলাম না।

বহুবছর পরের কথা।
আমি নিজেও এখন দেশের বাইরে। সেই একই কারণে। উচ্চ শিক্ষালাভ। ক্রমাগত ভুল মানুষের প্রেমে পড়ে পড়ে নিজেকে ক্লান্ত-শ্রান্ত করে তুলেছি। হঠাৎ একদিন একজনের জন্মদিনের দাওয়াতে গিয়ে টের পেলাম আমার আশেপাশের বাতাসে যেন একটা চেনা চেনা গন্ধ। প্রায় দশ বছর পর আমি আবার ঘর ভর্তি মানুষের মাঝে চোখ বন্ধ করতে গিয়ে হেসে ফেললাম। জীবনটা কি আর হিন্দী সিনেমা! পরে জন্মদিনের পার্টির এক কোনায় যখন চুপটি করে বসেছিলাম তখন হঠাতই কানে ভেসে  এল পরিচিত একটা হাসির শব্দ।

আমি তার কাছে গিয়ে বললাম, রুবি রায়, চিনতে পারছেন??



Sunday, August 30, 2009

শাপমোচন

আমার বন্ধু-ভাগ্য খুব ভাল।
কোথা থেকে জানি চমৎকার চমৎকার সব বন্ধু জুটে যায়।

আমার বন্ধু ভাগ্য আবার খুব খারাপও।
কেমন করে জানি সেইসব চমৎকার বন্ধুরা এক সময় হাওয়ায় উবে যায়।

সাধারণ মানুষের চাইতে আমি মনে হয় একটু বেশি স্বার্থপর। তাই হয়ত বন্ধুগুলো এক সময় আমার পাশে আর থাকতে চায় না। আমি দুই হাত ভরে ওদের কাছ থেকে নিয়েই চলি। ফিরিয়ে দেবার কথা মনেও হয়না।

কে থাকবে এমন একজন লোকের সাথে? আমি নিজেই থাকতাম না।

ইদানিং, জানিনা বয়েসের কারণেই কিনা, খুব করে মনে পড়ে হারিয়ে ফেলা সেই হীরের টুকরোগুলোর কথা।
সবচাইতে পুরোনো যে বন্ধুটির কথা মনে পড়ে---তার নাম জয়নাল। আমার ক্লাস সিক্সের বন্ধু। তখন আমরা নরসিংদীতে থাকি। জয়নাল ছিল ব্রাহ্মন্দী কে কে এম গভর্মেন্ট হাই স্কুলে আমার সহপাঠি। হ্যাংলা-পাতলা শরীর। একটা বেমানান রকমের বড় মাথা। সে মাথায় অস্বাভাবিক রকমের উজ্জ্বল দুটো চোখ। এইটুকুই কেবল মনে আছে। জয়নাল খুব চুপচাপ রকমের ছেলে ছিল। ক্লাসে পেছনের বেঞ্চে যারা বসে, তারা সাধারনতঃ যে রকম মার-কাটারী হয়---জয়নাল ছিল একেবারেই তার উলটো। ঐ স্কুলে আমি দুই বছর কাটিয়ে ছিলাম। ঐ সময়ে আমার বন্ধু মহলে যারা ছিল তারা সবাই আমার মতই ছিল। আমার মতই চঞ্চল। আমার মতই ভীতু। আমার মতই সচ্ছল। জয়নাল আমাদের মত ছিল না। তাই জয়নাল আমার বন্ধু ছিল না। গোটা দুই বছর নরসিংদীতে কাটানোর পর আমরা যখন আবার বদলী হচ্ছি তখন জয়নাল একদিন এসে আমাকে বলল, আমাকে তার নাকি খুব ভাল লাগে। এই দুই বছরে জয়নালের সাথে আমার কথা হয়েছে বড়জোর তিন-চার বার। এমন একজন যখন হঠাৎ করে এসে বলে----আমাকে খুব পছন্দ করে, তা উত্তরে কী বলতে হয়?

আমার জানা ছিল না।

আমি তাই কিছু বলি নি।

জয়নাল কিছুখন চুপ থেকে বলেছিল, তোমাদের নতুন জায়গাটার ঠিকানা দেবে? আমি তোমাকে মাঝে মাঝে চিঠি দেব। আমি বলেছিলাম, আমার ঠিকানাটা মুখস্থ নেই। কাল জেনে এসে জানাব।

পরের দিন দুপুরে ট্রেনে চেপে রওনা সিলেটের পথে। আমার বাবার নতুন বদলীর জায়গা। নতুন জায়গায় যাবার আনন্দে বুঁদ হয়ে থাকা আমার মনে জয়নালের কোন স্থান ছিল না। তাকে ঠিকানা না দেবার জন্যে কোন অপরাধবোধও ছিল না।

সিলেটে এসে যখন খুব জমে গিয়েছি আত্মীয়-স্বজন আর বন্ধু-বান্ধবের ভীড়ভাট্টায়---তখনি এক দুপুরে পিয়ন বাসায় একটা চিঠি নিয়ে এল। আমার চিঠি। লিখেছে জয়নাল।

আমি জানিনা সে কী করে আমার ঠিকানা জোগাড় করেছিল।কিন্তু এইটা জানি---সে চিঠি পেয়ে খুশি হবার বদলে
আমি কেন জানি খুব বিরক্ত হয়েছিলাম। কিছুটা ভয়ও পেয়েছিলাম।জয়নালে সে চিঠিতে উল্লেখযোগ্য কিছুই ছিল না। প্রচুর বানান ভুলের মাঝে সে জানিয়েছিল, আমার জন্যে তার মন পুড়ে। সে চিঠির কোন উত্তর আমি দেইনি।
মাস খানেক পরে জয়নালের আরেকটা চিঠি আসে। সেখানে সে জানায়---তার মন খুব খারাপ। নাহ, আমার জন্যে নয়। তার পাঁচ বছর বয়েসী ভাইটা মারা গেছে। ঘরের ছাঁদ থেকে ফ্যান খুলে পড়েছিল ওর উপর। এইটুকুই খবর।

আমার মনে আছে, আমি সেই চিঠিটার উত্তর দিয়েছিলাম। আমি তখন জানতাম না কী করে মানুষকে দুঃখে সান্ত্বনা দিতে হয়।তাই মা কে জিজ্ঞেস করেছিলাম। মা বলে দিয়েছিল। আমি লিখে দিয়েছিলাম।

জয়নাল আর আমার সাথে যোগাযোগ করেনি।

তারপর বহু বছর কেটে গেছে। জয়নালের চেহারাটা আস্তে আস্তে আমার মন থেকে মুছে গেছে। মুছে যায়নি শুধু সেই উজ্জ্বল চোখ দুটো---আর কান্না ভেজা চিঠিটা।সেই চিঠিটার কিছু কিছু অক্ষর পানিতে ভেসে গিয়েছিল।

জয়নাল কি কাঁদছিল চিঠিটা লেখার সময়?
জানিনা, জানা হয়নি----

আমি জানিনা জয়নাল আমার উপর অভিমান করেছিল কি না। আমি জানিনা জয়নাল আমাকে কোন অভিশাপ দিয়েছিল কি না। কারণ এর পর থেকে আমি বারবার বন্ধু পেয়েছি--কিন্তু হারিয়েছি তারচেয়েও বেশিবার। যাদেরকেই বন্ধু বলে কাছে টেনেছি---কিছুদিন পর কোন এক কারণে তারা সরে গেছে আমার কাছ থেকে। আমার দিক থেকে যথাসাধ্য চেষ্টা সত্ত্বেও সেই সম্পর্কগুলো আর জোড়া লাগেনি। বারবার প্রিয় বন্ধু হারানোর বেদনায় ভাসতে হয়েছে আমাকে। যতবার আমার কোন প্রিয়বন্ধু আমাকে ছেড়ে চলে গেছে--ততবার আমি টের পেয়েছি বিশাল দুটি চোখে কে যেন অবজ্ঞা ভরে, করূণা ভরে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।আমি টের পেয়েছি কী এক অভিশপ্ত জীবন আমি বয়ে চলেছি।

জয়নাল আমাকে অভিশাপ দিয়েছে। আমি তাই এক জয়নাল হয়ে উঠেছি--যাকে হেলা ভরে ফেলে দেয়া যায়, ভুলে যাওয়া যায়,ঠিকানা দেব বলে না দিয়ে চলে আসা যায়।

মাত্র কিছুদিন আগে আমাকে আবার এক পরম মিত্রকে হারাতে হল। খুব খুব ভাল একটা বন্ধু ছিল। আমার সকল আহ্লাদ, সকল অনুযোগ, সকল স্বপ্ন আর স্বপ্নভঙ্গের কথা শোনার সেই একমাত্র লোক ছিল। তার সান্নিধ্যে বড় নিরাপদ বোধ করতাম। ক্ষনিকের ভুলে মনে হয়েছিল--হয়ত আমার সে শাপ মোচন হয়েছে। ভেবেছিলাম, এবার হয়ত আর বন্ধু হারানোর বেদনায় ভুগতে হবে না।

ভুল ভেবেছিলাম।

ঠিক যখনি স্বস্তিবোধ করতে যাচ্ছিলাম, ঠিক তখনই আঁধি এসে নিয়ে গেল তাকে।
আমাকে রেখে গেল একা সুনসান পথের ধারে।

কেন জানি নিজেকে Ancient Mariner এর সেই মৃত এলবাট্রস গলায় ঝুলিয়ে থাকা অভিশপ্ত নাবিক মনে হয়।
সে নাবিকের শাপ মোচন হয়েছিল---আমার হবে কি??

Monday, April 13, 2009

এ পথে আমি যে গেছি বার বার

অনেক আগে, মন ভালো করার দায়িত্ব দিয়েছিলাম একজন কে।
তারও আগে, মন ভালো করার দায়িত্বে ছিল একটা পাহাড়।
মন খারাপ হলেই গিয়ে বসে থাকতাম তার চুড়োয়।

আমার শাবিপ্রবির জীবনটা নানা টানা পোড়েনের মাঝে কেটেছে। শাবিপ্রবি তে এসে আমি প্রথমবারের মত পৃথিবীর পথে একা নেমেছিলাম। তার আগে 'পৃথিবীর পথে' আর 'পৃথিবীর পাঠশালায়' ঘোরা হয়েছে ম্যাক্সিম গোর্কির হাত ধরে। বইয়ের পাতায় পড়া সংগ্রামের সাথে যাপিত জীবনের সংগ্রামের কোনো মিল ছিল না। গোর্কি পড়ে পড়ে মনে হয়েছিল, জীবনের সকল কষ্টের মুখ আমার চেনা হয়ে গেছে। আমাকে আর চমকে দেয়া সহজ নয়। নিতান্তই অপোগন্ড ছিলাম।

আজ এত বছর পর, তাকিয়ে দেখি---এখনো অপোগন্ডই রয়ে আছি।

শাবি-তে আমাকে নানান কষ্টের মধ্যে পড়তে হয়েছিল। খাওয়ার কষ্ট, নাওয়ার কষ্ট। আশাভঙ্গের কষ্ট। নিজেকে চেনার কষ্ট। কত কি!
সে সময় আমার অনেক 'বন্ধু' ছিল। কিন্তু বন্ধু তেমন কেউ ছিল না। কেউ ছিল না যার কাছে গিয়ে বলতে পারি, জানো ভাই, আমার বড্ড কষ্ট হচ্ছে, কিন্তু জানিনা কেন। আমি তোমার কাছে একটু বসি ? তুমি কি কিছু একটা বলে আমার মন ভাল করে দেবে?

ক্রমশ দলছুট হয়ে যাচ্ছিলাম। দেখলাম---আমার দুঃখের কথা শোনার অবসর কারো নেই।তারচেয়েও বড় কথা-- আমারও বলার মত কোন দুঃখ নেই, অথচ বুকে দলা পাকানো কান্না। সবাই আমার হাসিমুখ দেখতে চায়। মন ভার হয়ে থাকলে, মুখে ছাপ পড়ে সবার আগে। আমার মুখ দেখেই হয়ত বোঝা যেত যে মন খারাপ। কেউ তখন কাছে ঘেসত না।

অথচ তখন সামান্য একটু স্নেহের কথা, প্রশ্রয়ের কথা শোনার জন্যে নিদাঘ কালের পিয়াসী চাতক হয়ে থাকতাম। সবার সাথে ভীড়ে গিয়ে মন ভুলিয়ে রাখার চেষ্টায় আমি ক্রমশ ক্লাসের ভাঁড়ে পরিনত হলাম। সব সময় হাসি। সব সময় উচ্ছাস। সব সময় গান-বাজনা। ক্লাসের ফাঁকে টেবিল চাপড়ে গান গাওয়া----বন্ধুদের কাছ থেকে পিঠ চাপড়ানো পাওয়া। সেই সম্বল করে রাতে ঘরে ফেরা।

দিনের পর দিন সঙ সেজে থেকে থেকে, মুখে রং মেখে থেকে থেকে ভুলে যাচ্ছিলাম আমার নিজের মুখ।

কিসের যে বিপন্নতা বোধ আমাকে আচ্ছন্ন করে রাখত---সেটা আজো আমার জানা হয়নি। শুধু মনে রয়ে গেছে সেই তীব্র হতাশার আঁচড়্গুলো।

সেই সময় আমি তাকে খুঁজে পাই।

এক বিকেলে একা একা হাটতে বেরিয়ে অনেক দূরে চলে গিয়েছিলাম। সূর্য তখন সারা দিনের ক্লান্তি মুছে ঘরে ফেরার জন্যে তৈরী। ঘরে ফেরার খুশিতেই হয়ত মুখখানা তার বড় উজ্জ্বল। আমি সূর্য দেখতে দেখতে, সবুজ ঘাসের মাঝে হারাতে হারাতে এক সময় হারিয়ে গেলাম। ঠিক তখুনি আমার সামনে এসে দাঁড়াল সে। চারদিকে ছোট ছোট টিলা। তাদের বুকের মাঝে আগলে রেখেছে ছোট্ট একটা টিলা। সারা চরাচরে আর কেউ নেই যেন। শুধু আমি আর সে।

আমি খুব সাবধানে তার গায়ে হাত রাখলাম। সবুজ ঘাসের গালিচা বিকেলের কুয়াশার গন্ধ বুকে মেখে বড় আদুরে হয়ে ছিল। আমি হাত রাখতেই সে একেবারে বুকের মাঝে টেনে নিয়ে গেল। আমি মন্ত্রমুগ্ধের মত চলে গেলাম তার কাছে। উঠে গেলাম তার চূড়োয়। চারিদিকে কেউ নেই। কিছু নেই। আদিগন্ত বিস্তৃত ফসলের মাঠ। কুয়াশার চাদরে ঢাকা ঘন নীল কিছু পাহাড়। আর মাঝখানে আমি।

আমি স্তম্ভিত হয়ে ভাবছিলাম---এতদিন আমি এখানে আসিনি কেন? তখন সন্ধ্যে হয়ে গেছে। সেই ছোট্ট পাহাড় থেকে আমার নামতে ইচ্ছে করছিল না। বহু বছর পর প্রথমবারের মত একটা অদ্ভুত অনুভুতির সুর বাজছিল মনে। অনেক পরে জানতে পেরেছি---ঐটেই ছিল শান্তির অনুভুতি।

এরপরে যতবার আমার শান্তির দরকার হয়েছে---আমি ছুটে গেছি তার কাছে।
আমার বন্ধুরা আমাকে ছেড়ে গেছে, আমি চলে গেছি তার কাছে।
অনেক দিন ধরে যাকে কিছু কথা বলব বলে ভেবে রেখেছিলাম, ভেবে রেখেছিলাম পৌষ-সংক্রান্তির সকালে যাকে বলব আমার ছোট্ট একটা গোপন কথা------ জীবনের বাকী সব উৎসবে শুধু তার হাত ধরে থাকতে চাই, খুব কাছের এক বন্ধুর কান্না দেখে, তাকে সে কথা না বলে চলে এসেছি। চলে গেছি আমার পাহাড়ের কাছে। এরপর যতবার তাদের দু'জনকে একসাথে দেখেছি, ততবার আমার পাহাড়ের কাছে ছুটে গেছি। চুপ করে বসে কাটিয়ে দিয়েছি সারাটা বিকেল।কখনো অজান্তে ভেসেছি চোখের জলে। আমার সে পাহাড় সব দেখেছে। কিন্তু একবারও বকে দেয়নি। একবারও আমার কান্না দেখে হাসেনি। একবারও বলেনি, ছিঃ তুমি না পুরুষ মানুষ, ছেলেদের যে কাঁদতে হয়না। একবারও সে বলেনি---দুঃখ করো না, এরচেয়ে ভাল কত মেয়ে তুমি পাবে---! নাহ, কোনও মিথ্যে স্তোকবাক্য সে শোনায়নি। বরং সে বলেছিল, তুমি যা হারিয়েছ, তারজন্যে দুঃখ করো। প্রতিটা মানুষ অমুল্য ধন। কাউকে হারালে---তুমি এক অনন্যসাধারন কেই হারাও। তাই দুঃখ কর।

আমি যখন তাকে আঁকড়ে ধরে শুয়ে থাকতাম---আমার সকল দুঃখ সে যে শুষে নিত। আমার খুব কষ্টে জমানো কিছু সুখের গল্প, আমার ভান্ডার উপচে পড়া দুঃখের গল্প---- সব কিছুর শ্রোতা হয়েছিল সে।

এক সময়, শাবি-র দিন শেষ হয়। চলে যেতে হয় অন্য কোন খানে। জীবন তার নানান শিকে বিদ্ধ করে আমাকে তপ্ত আঁচে ঝলসে নেয়।
সামান্য শ্বাস ফেলার সুযোগ পেলেই চলে যেতাম সিলেটে। সেখানে গুটিকয় মানুষ আর একটা পাহাড় আমার অপেক্ষায় থাকত। প্রতিবার তার সাথে দেখা করতে যাবার আগে, ঠিক প্রিয়া-অভিসারে যাবার মত দমবন্ধ করা একটা অনুভুতি হত। গিয়ে তার দেখা পাবো তো? খালি মনে হত---আমার একমাত্র সুখের এই স্থান যদি কেউ কেড়ে নেয়। কোন লোলুপ-লুম্পেন ঠিকাদারের শাবলের নীচে হয়ত
সে হারিয়েছে তার ঐশ্বর্য, তার যৌবন, তার কুমারীত্ব। প্রতিবার গিয়ে তার দেখা পেতাম----আর কেন জানি অপার কৃতজ্ঞতায় মনটা ভরে উঠত। সে আছে, সে আছে---সে এখনো আছে!

তারপর বহুদিন পর দেশ ছাড়ার ডাক এল। আমি সবার কাছ থেকে বিদায় নিলাম। সিলেট ছাড়ার আগের দিন সন্ধ্যায় মা কে বললাম, মা আমি আমার এক বন্ধুর সাথে দেখা করতে যাই, বিদায় নিয়ে আসি। মা জিজ্ঞেস করে কোন বন্ধু। আমি বলি আমার পাহাড়ের কথা। ভেবেছিলাম মা হয়ত হেসে উঠবে অথবা হয়ত বিরক্ত হবে আমার এইসব পাগলামীতে। কিন্তু মা সেসব কিছুই বলল না। মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, যা দেখা করে আয়!

সে সন্ধ্যায় আমি বসেছিলাম আমার পাহাড়ের কাছে। কেউ কোন কথা বলিনি। কেউ কাউকে বিদায় বলিনি।

এক হাজার দিন শেষে যখন ফিরি দেশে----তার সাথে দেখা করতে ছুটে গেছি আমি। প্রচন্ড উৎকন্ঠায় দেখেছি শাবির ক্যাম্পাসের শ্রীবৃদ্ধি। ঠিকাদারদের শাবলের নীচে চলে গেছে কত কত পাহাড়, কত কত মাঠ---আমার বন্ধু কি আছে? কোনভাবে সে কী বাঁচতে পেরেছে??

আমাকে অবাক করে দিয়ে, সে দেখা দিল হাসিমুখে। আমার মতই তারো বয়েস হয়েছে দেখলাম। আমার মতই তার মাথায় পড়েছে টাক। আর আমার মতই সে রয়ে গেছে পরস্পরের বন্ধু হয়ে। তার গায়ে হাত বুলাতে বুলাতে জিজ্ঞেস করেছি, কী রে পাগলা কেমন ছিলি? সবার নজর এড়িয়ে ছোট্ট একটা চুমু দিয়ে এসেছি তার গায়ে। এবার ফেরার আগে কিনেছি একটা ছোট্ট তাবিজ। সেইখানে ভরে নিয়ে এসেছি আমার বন্ধুর পদধুলি। খুব মন খারাপ হলে আমি সে তাবিজ আমার গলায় ঝুলিয়ে দেই। আমার বুকের কাছটায় বসে বন্ধু বলে----আমি আছি, তুই চিন্তা করিস না।

এর মাঝে কত কী হয়ে গেছে আমার এই নগন্য জীবনে। কত বন্ধু বদলে গেল ঋতু বদলানোর আগেই। কত নতুন মুখ ভীড় জমালো মনের জানালায়। এর মাঝে কোন একজনকে কিছু সময়ের জন্যে মন-ভালো করার দায়িত্বটাও দিয়ে ফেলেছিলাম,ভুল করে। ভুল করে। ভুলে গিয়েছিলাম হাজার হাজার মাইল দূরে আমার এক বন্ধু দীর্ঘ দিবস দীর্ঘ রজনী জেগে থাকে আমার দুঃখ গুলো বুকে নিয়ে। সে কখনও আমাকে ফিরিয়ে দেয় নি শূন্য হাতে।

এখনো যতবার বুকের পাড় ভাঙ্গে, আমার ছুটে যেতে ইচ্ছে হয় আমার সে বন্ধুর কাছে---ইচ্ছে হয় তাকে জড়িয়ে ধরে বলি,বন্ধুরে আর যে পারিনা-----আর তো পারিনা-----


বন্ধু, তুই ভাল থাকিস-------

Saturday, March 7, 2009

মনের হদিস----

"মনের হদিস কেইবা জানে
কী যে থাকে মনের কোনে
কেউ জানে না, কেউ জানেনা
সেও জানে না যে ধারন করে----

খাঁচার পাখি আকাশ খোঁজে
বোঝে না সে বোকা
আকাশ ধরতে গোটা জীবন
খাবে সময় পোকা
তবু পাখির মন তো আকাশ পরে
কেন যে মন এমন করে
কেউ জানে না কেউ জানে না
সেও জানেনা যে ধারন করে----

খুঁজতে গিয়ে ভালবাসা ঘুরি পথে পথে
হাজার নিন্দা চাদর করে চড়ি ধুলোর রথে
জানি ভালবাসা আছে ঘরে
তবু যে মন খুঁজেই মরে
কেউ জানে না কেউ জানে না
সেও জানেনা যে ধারন করে----"


আজ এমন ঝলমলে দিন করল যে বাইরে বেরিয়ে মনটাই ভাল হয়ে গেল। মনে হল যেন সাপের মত চামড়া খুলে ফেলে বেরিয়ে এসেছি পৃথিবীর পথে। পৃথিবীর পথে বেরিয়েই দেখা শ্রীনি'র সাথে, সাথে সাক্ষাৎ স্যাঙ্গাৎ সাইফ। শ্রীনি আর সাইফ---ভিনদেশের দুইটি প্রান যেন একই সুরে বাঁধা---গাড়ি,গাড়ি,গাড়ি। উইকএন্ডগুলোর সদ্ব্যবহার করার জন্যে দুই জনেই সারা সপ্তাহ মুখিয়ে থাকে। শনিবার মানেই---গাড়ি খুলে ফেলে সব খুলে ফেলা। যে ইস্কুরপ টাইট, সেইটে খানিক ঢিলে করা, ঢিলেটাকে টাইট এবং ফাঁকে ফাঁকে নিত্য নতুন গাড়ির মডেল নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষন। আমাকে দেখে দুইটি কালিমাখা মুখে হাসি দেখা গেল। টাইমিং বেল্ট কী এবং সেটা ঢিলে হলে কী হতে পারে, সেই নিয়ে শ্রীনি মনে হল একটি দীর্ঘ বক্তৃতার প্রস্তুতি নিয়েছে। এমন চমৎকার দিন---যে এই অত্যাচারটা গায়েই লাগল না।

বিকেল আরেকটু এগিয়ে এলে বেরিয়ে পড়লাম কাছে পিঠে ঘোরার জন্যে। সাথে সাইফ। সাইফ এখন আমাকে প্ল্যাসেন্টার সাথে ইউটেরাসের কী রকম সম্পর্ক, প্রি-ম্যাচিওর ডেলিভারী হলে বাচ্চাদের কী হয়, এই জাতীয় নানান 'জ্ঞানগর্ভ'(গর্ভ নিয়ে জ্ঞান, আর কি---) বক্তৃতাতে ব্যস্ত। আইপড বেচারী নানান গান বাজিয়ে যাচ্ছে---সাইফ কোন গানেই ঠিক জুত পাচ্ছে না।
খানিক এদিক সেদিক ঘুরে, বার কয়েক পথ হারিয়ে, হঠাৎ করে একটা বিশাল সবুজ মাঠের টিকলী ছুঁয়ে আমরা ঘরে ফেরত। সাইফ কে নামিয়ে দিয়ে, আমি অনেকখন পর আমার সাথে একা। একছুটে আবার বেরিয়ে পড়লাম রাস্তায়।

রাস্তায় বাতি জ্বলে উঠেছে।নামিয়ে রাখা জানালা দিয়ে হু হু মাতাল বাতাস ঢুকছে। ঢুকেই সে গাড়ির পেছনের সীটে রাখা টিশু পেপার নিয়ে খেলায় মত্ত। রীতিমত ঝটপট লড়াই চলছে দু জনের মাঝে।ডানে বামে গাড়ির স্রোত।উজ্জ্বল চোখের মানুষ।উচ্ছল কেশের মানুষ।গম্ভীর, সুখী, উদ্ভ্রান্ত--কত রকমের মুখ। দৃশ্যের পর দৃশ্যের ঝাপটা। হঠাৎ করেই আমার আইপড খুঁজে পায় শুভমিতাকে। শুভমিতার কন্ঠে বাজে অনাদিকালের বিরহ যাতনা---মনের হদিস কেইবা জানে---কেউ জানে না, কেউ জানে না, সেও জানে না যে ধারন করে------

এক ঝটকায় গাড়ি নিয়ে আসি পথের ধারে--চারপাশের সুশীল চালকদের তীব্র উচ্চকন্ঠ প্রতিবাদ উপেক্ষা করেই।নাম না জানা এক পথের ধারে গাড়ি থামিয়ে স্থানুবৎ বসে থাকি আমি। দূরে এখনো আকাশে রয়ে গেছে কিছু রং। রাস্তার পাশে খোলা মাঠ।নীলাভ কুয়াশা জমে আছে চেপে রাখা কান্নার মত।

আর, সব দৃশ্যপট ছাপিয়ে শুভমিতা আমাকে জানান, মনের হদিস কেইবা জানে---কেউ জানে না কেউ জানে না---

কেউ জানে না, কেউ জানে না----কেউ জানে না, কেউ জানে না----কেউ জানে না, কেউ জানে না----কেউ জানে না, কেউ জানে না----কেউ জানে না, কেউ জানে না----কেউ জানে না, কেউ জানে না----কেউ জানে না, কেউ জানে না----কেউ জানে না, কেউ জানে না----কেউ জানে না, কেউ জানে না----কেউ জানে না, কেউ জানে না----কেউ জানে না, কেউ জানে না----কেউ জানে না, কেউ জানে না----কেউ জানে না, কেউ জানে না----কেউ জানে না, কেউ জানে না----কেউ জানে না, কেউ জানে না----কেউ জানে না, কেউ জানে না----কেউ জানে না, কেউ জানে না----কেউ জানে না, কেউ জানে না----

Sunday, October 26, 2008

নিঃস্বপ্ন

এই দেশটায় আসার পর যতগুলো গুরুত্বপুর্ণ ঘটনা ঘটেছে আমার জীবনে, তার মাঝে 'নিঃস্বপ্ন' হয়ে যাওয়াটা অন্যতম।
আমি স্বপ্ন ভঙ্গের কথা বলছি না। আমি স্বপ্নহীনতার কথা বলছি।

দেশে থাকতে আমার বেশ কিছু স্বপ্ন ছিল। এটা সেটা করার। এটা সেটা হবার।

এখানটায় আসার পর আমি আর স্বপ্ন দেখিনা।

মাঝে মাঝে মরার মত ঘুম আসে। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে চোখ ফুলিয়ে দেই। কিন্তু কোন স্বপ্ন দেখিনা।
প্রবল ঘুমের পর জেগে উঠে মনে হয় হাজার বছর ধরে আমি জেগে আছি। আমি আমার চেনা মানুষদের মাঝে ভান ধরে বসে থাকি।
কেবল হাসি, কেবল ঠাট্টা। একের পর এক অক্লান্ত ঠাট্টাবাজীতে নিজেই নিজেকে ফতুর করে দিই। তারপর সব কোলাহল ফুরোলে ঘরে ফিরি নিজের টুকরো গুলো কুড়িয়ে নিয়ে।

দিনের পর দিন এ পৃথিবীটা খয়েরী হয়ে যাচ্ছে আমার চোখের সামনে। রাস্তা ঘাটে দেখি--কত মানুষ হা হয়ে তাকিয়ে দেখছে হেমন্তের আবির্ভাবে রঙ্গীন হয়ে ওঠা গাছের শোভা। পথ জুড়ে পড়ে আছে কত বাহারী রঙের পাতা। আমি ক্লান্ত চোখে তাকাই।
শুধু ওদের ঝরে পড়ার সাথে আমার কোথায় যেন মিল খুঁজে পাই।

মাঝে মাঝে নিজেকে খুব করে বকে দিই। আমার এসব আসলে দুঃখ বিলাস। হবেও বা। ঠিক এই মুহুর্ত্তে কত শত লোক তাদের জীবন বিপন্ন করছে, কত শত শিশুর জীবন বিকিয়ে যাচ্ছে বুলেটের দামে। আর আমি? নরম গদিতে ঠেস দিয়ে বসে লিখছি আমার স্বপ্নহীনতার কথা।

ফক্কুলের সাথে মাঝে মাঝে কথা হয় রাত জেগে। একে অন্যের ঘা চেটে চেটে দিই। একসাথে দুই জনেই দীর্ঘশ্বাস ফেলি। ঠিক কখন আমরা হারিয়ে গেলাম মুল স্রোত থেকে? ঠিক কখন আঁধি এসে নিয়ে গেল পথ ভুলিয়ে? এ সকল হাবিজাবি ভাবি। শেষে দুই জনেই একমত হই---আমাদের দিয়ে আর কিস্যু হবে না।

ফক্কুলের তাও একটা বড় কাজ শেষ হয়েছে-পি এইচ ডি। আমার এখনো ঝুলছে। কতদিন ঝুলে থাকতে পারব কে জানে।

আমার করা হল না কিছুই।

আমার কথা ছিল বুড়ো বাবার হাত ধরে টুকটুক করে রাস্তা পার করে দেয়া। আজ হয়ত পথের মাঝে নাম-না-জানা কেউ এসে আমার বাবার হাত ধরে----ধীরে ধীরে আমার বাবা পার হয় রাস্তা। ঝুকে ঝুকে বারবার ধন্যবাদ জানায়। আমার কথা ছিল পহেলা বৈশাখের সকালে মায়ের সাথে সংস্কৃত কলেজের আমতলায় যাওয়া। একরাশ রোদ্দুরের মত কচি কচি কন্ঠে বেসুরো রবীন্দ্র সঙ্গীত শুনে মাথা দোলানো। কথা ছিল, বোনটা গানের সিডি বের করলে তাতে বাজবে আমার তবলা।

আজ আমার বাবা কে পথ পার করিয়ে দেয় অচেনা কোন হাত।
আজ আমার মা আর পহেলা বৈশাখের দিন মনে রাখে না।
আমার বোনের সিডিতে নাম না জানা এক তবলিয়া বাজিয়ে যায়।

আর আমি?

হাজার হাজার মাইল দূরে আমার অনাগত দিনের মত অন্ধকার শীতল রাতে পথের ধারে ঘাড় নীচু করে বসে থাকি। দূরে কোথাও কিছু সুখী মানুষের স্বর শুনি। প্রানপনে চোখ বুজে ভাবার চেষ্টা করি---এসব ঘোর মিথ্যে। আমি চোখ খুললেই পৌছে যাব----

কোথায়? কে জানে।

দিনের পর দিন নি;স্বপ্ন থেকে থেকে বন্ধ্যা হয়ে আসে ভবিষ্যত। আমি এমন এক পথে দাঁড়িয়ে আছি---এ পথে না যায় এগুনো, না যায় পিছানো।

আমার তুমুল প্রেম যার সাথে----সেই পদার্থবিজ্ঞান জানিয়েছে অনেক আগে---আমি তার যোগ্য নই। তাঁকে ঘিরে কত সুদর্শন মসৃন চামড়ার পুরুষের ভীড়। আমি অ-নে-ক দূর থেকে উঁকি দিয়ে দেখতে পাই। তাঁকে ঘিরে চলেছে দেবী বন্দনা।


আমার কেবলি মনে হতে থাকে---মানুষের এই বিশাল কর্মযজ্ঞে আমি এক অপ্রয়োজনীয় কাঠের টুকরো। কোন ফাঁকেই আমাকে গোজা যায় না। কোন কিছুরই আমি অংশ হতে পারি না।

না আমার স্বজনের।
না বিজ্ঞানের।
না এই বিশ্বের।

কি যে অপ্রয়োজনীয় এই বেঁচে থাকা!

Sunday, September 14, 2008

আমার আনন্দ দিন

আজ বিকেলে ডিপার্টমেন্টে গিয়ে বসে আছি। কিছু কাজ জমে আছে।
গড়িমসি করে করে আর শেষ করা হয় না। আলসেমি আর Procrastination এ আমি বিশেষ ব্যুৎপত্তি
অর্জন করেছি বলেই মনে হচ্ছে। যত না কাজ করি, তার চেয়ে বেশি আগডুম বাগডুম ভাবি।

এখানে আসার পর থেকে আমার সারাটা সময় কাটছে ভারতীয়দের সাথে। দক্ষিন ভারতের ছেলে পিলে।
আজ তো প্রায় পাঁচ বছর হতে চলল। কোথাকার কোন আমি, কোথাকার কোন শ্রীনিবাসন --- ভাগ্যের অদ্ভুত খেয়ালে পাঁচ পাঁচটি বছর ধরে এমন ভাবে আছি---যেন সে আমার হারিয়ে যাওয়া ছোট ভাই।

আমার যাদের সাথে ওঠাবসা, তাদের মাঝে সঙ্গত কারনেই আমি বর্ষীয়ান। আমার বয়েসের সব চাইতে কাছাকাছি যে আছে, সে কম করে হলেও চার বছরের ছোট। কিন্তু এরা বয়েসে ছোট হলে কি হবে--মেধায়, প্রজ্ঞায় আমার চেয়ে এগিয়ে।

এদের সাথে ওঠাবসা করতে করতে আমার মাঝে বেশ একটা 'তামিল' 'তামিল' ভাব চলে এসেছে। আমি ওদের বেশ কিছু ভাল গালাগাল মুখস্থ করে রেখেছি। সময়ে অসময়ে সেগুলো 'আবৃত্তি' করে বেশ আমোদ পাই।
আমার চেহারাতে দ্রাবিড় ভাব প্রকট। এক সকালে আমার রুমমেট শ্রীনি'র এক বন্ধু এসেছে বেড়াতে। বেচারা এসেছে ভার্জিনিয়া থেকে। শ্রীনি তাকে লিভিং রুমে বসিয়ে দিয়ে গোসল করছে। এরমধ্যে মঞ্চে আমার প্রবেশ। মাত্র ঘুম থেকে উঠেছি---এর মাঝে ডান চোখের ঘুম মনে হচ্ছে কাটেনি। কেবল বাঁ চোখে পিটপিট করে তাকচ্ছি। সেইটাতে আবার আমি তেমন ভাল করে দেখতে পাইনা। কিন্তু কি আর করা। ডান চোখটাকে জাগাতে ইচ্ছে করছে না। বাথরুম শ্রীনি'র দখলে। সে বেরুলে পরে আমি যাব। এরই মাঝে টলতে টলতে আমি লিভিং রুমে হাজির।

কিছুক্ষন কারো মুখে কথা নেই। আমাদের যেন তিন চক্ষুর মিলন হল(ডান চোখ তখনো ঘুমুচ্ছে)। নীরবতা ভেঙ্গে আমিই 'হাই' বললাম। হাত বাড়িয়ে করমর্দন করতে করতে জানা গেল, সে অশোক। অশোক এখন আমাদের টিভিতে একটা তামিল ছবি দেখছে। কিছু লোক অস্বাভাবিক দ্রুততায় কথা বলে যাচ্ছে। অনেকটা কিচির-মিচিরের মত শোনাচ্ছে। ভাগ্যিস, আবহ সঙ্গীত ছিল। শুনে মনে হল---কমেডি চলছে হয়ত।

আমি আবার আধা ঘুম আর আধা সজাগ অবস্থায় চলে গেছি। একমাত্র যে চোখ, সেইটাও বিট্রে করছে। মনে হচ্ছে, আর কিছুক্ষনের মাঝে সেও ধর্মঘটের ডাক দিয়ে দেবে।

এমন সময়----

'ইড়িম পিড়িম গিড়ম কুর কুর, উঁ, হেহেহে"

আমি চমকে উঠে বিষম খেয়ে খুজছি আওয়াজের উৎস। দেখি অশোক আমার দিকে সপ্রশ্ন ব্যাকুল হয়ে তাকিয়ে আছে।

"ঈড়ম গিরম ঘিড়ম ভু ভু কু কু, উঁ? হে হে হে হে"

আবারো সেই যান্ত্রিক ক্যাচক্যাচ। দেখলাম অশোক বাবাজী আওয়াজ দিচ্ছেন। এবং মুখটা সপ্রশ্ন ভাব ছেড়ে ধীরে ধীরে 'সক্রোধ' এলাকায় চলে যাচ্ছে।

ড্যামেজ কন্ট্রোল করতে হলে এখনি---

'ইয়ে, আমাকে কিছু বলছ?', ইংরেজীতে সাবধানী প্রশ্ন আমার।
এবার বেশ দ্রুত কিছু কিড়মিড় আওয়াজ শোনা গেল। মনে হল অশোক কিছুটা Offended feel করছে।
বাধ্য হয়ে বলতে হল, ভায়া হে, আমি তো তামিল-কানা। আমাকে দেখে তামিল মনে হলেও এ বান্দা বাংলাদেশের। 'এন্না ভিশেষাম"(তামিল ভাষায়, কেমন আছেন) এবং আরো কিছু অনুচ্চার্য্য গালি গালাজ আমার সম্বল। এর বাইরে আমি পুরো কানা।

এখন দেখি অশোক কাঁচুমাচু। বেশ অপ্রস্তুত হাসি হেসে জানাল, আমার চেহারা এত্ত 'convincing' যে সে ধরেই নিয়েছে আমি তামিল ভাষাভাষি। এইটা নিয়ে খানিক হো হো হবার পর জিজ্ঞেস করলাম, সে ঐ সময় কি বলছিল আমাকে? জানা গেল, আমার ধারনা সত্যি। ঐটা আসলেই কমেডি 'ফিলিম' এবং একটা পর্যায়ে দারুন নাকি হাসির সিকোয়েন্স গিয়েছে। আমাকে হাসতে না দেখে এবং ঝিমুতে দেখে বেচারা চাইছিল তার সাথে এই আনন্দ-যাত্রায় আমাকেও শরীক করতে।

কিন্তু হা হতোস্মি!

ভাষার কারনে আশা পুরন হইল না।