চাঁদের সাথে আমার পরিচয় বেশ ছোটবেলায়। খুব ভ্রু কুচকে চিন্তা করলে হয়ত বয়সটা ও বের করে ফেলতে পারব।তবে সবচাইতে যেটা আমার পরিস্কার মনে আছে সেটা হল,আমি কোনো গাড়ির পেছনের সিটে শুয়ে আছি আর অবাক হয়ে ভাবছি,ঐ জ্বলজ্বলে চাঁদটা আমাদের সাথে সাথে চলছে কেন? খুব সম্ভবত এইটাই আমার জীবনের প্রথম অমীমাংসিত রহস্য(পরে অবশ্য আবিস্কার করেছি প্রায় প্রতিটি ব্যাপারই আমার কাছে 'রহস্যজনক'এবং কোনটারই কুলকিনারা করতে পারিনা আমি)। মনে আছে এই নিয়ে বাবাকে বেশ খানিকটা জ্বালাতন ও করেছিলাম।
চাঁদের সাথে পরর্বতিতে আবারও অস্বস্তিকর মোলাকাত হল আমার---এই বার বইয়ের পাতায়।
অদ্ভুতরকমের গাবদা গাবদা জামা পড়ে এক লোক চাঁদের মাটিতে হাটছে। চাঁদের মাটিতে! পেছনে তার নিকষ কালো আকাশ।কাছেই কিম্ভুত রকমের একটা বিশাল যন্ত্র(Lunar shuttle)। ছবিটা দেখে আমার প্রায় নিশ্বাস বন্ধ হয়ে এল। কি সর্বনাশ! যে চাঁদ রাতের বেলা আমার সাথে পাল্লা দিয়ে দৌড়ায়, মানুষ সেই খানে চলে গেছে? শুধু একটা মাত্র মন খারাপের ঘটনা ঘটল। চাঁদের বুড়ি বা তার চরকা কোন কিছুই নাকি খুজে পাওয়া যায়নি। সেইদিনই বাড়ি ফিরে আমাদের বাবুর্চি মিয়াকে ডেকে ব্যাপারটা বললাম। বাবুর্চি মিয়া ছিল সেই সময়ে আমার partner in crime(ভাল বাংলা খুজে পেলাম না)।সে চোখ গোল গোল করে বলল, এই সব মিথ্যে কথা। মানুষ চাঁদে যেতে পারেই না। আমি দৌড়ে গিয়ে বই এনে দেখালাম। সে তাতে ও তার সিদ্ধান্তে অটল। বিজ্ঞানকে গ্রহনযোগ্য করা যে বেশ কস্ট সাধ্য ব্যাপার---আমি তখনি জেনে গিয়েছিলাম।
যাই হোক, দিনে দিনে আমি বেড়ে উঠতে লাগলাম, এবং চাঁদ থেকে দূরে সরে যেতে থাকলাম। সে আকাশে থাকে। আমি পৃথিবীর ধুলোয় গড়াগড়ি দেই। কৃষ্ণ পক্ষে শুক্ল পক্ষে চাঁদ তার রুপ বদলায়, আমি ক্লাসে পড়া না পারার জন্য মার খাই।
তারপর এল সেই অসহনীয় বয়সটা---আমার চারপাশের সবকিছুই হঠাৎ করে অচেনা হয়ে পড়ল। মনে হল আমার শরীরে ভেতর এক উন্মাদ লুকিয়ে আছে। এতদিন মানুষের মধ্যে যে আরেক প্রজাতি আছে, আরেক লিঙ্গের মানুষ আছে সেই সম্পর্কে একেবারেই অজ্ঞ ছিলাম। হঠাৎ করে মেয়েদের দেখা মাত্রই বুকের মাঝে ধাক্কার মত লাগতে থাকল। আমি মোটামুটি যখন নিশ্চিত যে আমি ভীষন বাজে কোন অসুখে পড়েছি,তখনি জানলাম, শুধু আমি না, আমার প্রায় সব বন্ধুর একই অবস্থা। কারো কারো আরো খারাপ।
এই সময়টাতে আমার সর্বনাশ করল দুইটা জিনিস---হুমায়ুন আহমেদ আর ----আমার চিরপরিচিত চাঁদ। হুমায়ুনের লেখা পড়ে আমি অভিভুত।শংখনীল কারাগার পড়তে পড়তে মুখস্থ হবার যোগাড়।আমি তার বই বারবার পড়ি,বারবার একই রসিকতায় হাসি।প্রতিবার নায়িকার অকাল প্রয়ান মুহূর্তে অশ্রু সমাকুল হই। হুমায়ুন প্রায় আমার কান ধরে চাঁদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। এতদিন পরে চাঁদ যেন স্বমহিমায় আমার সামনে আবির্ভুত হল। চাঁদ কে আমার আর মাটির ডেলা মনে হল না। মনে হল না যে ঐ চাঁদের মাটিতে লাফিয়ে ঝাপিয়ে এসেছেন কিছু মর্ত্যবাসী।
চাঁদ আবার ফিরে পেলো তার 'রহস্যময়ী' রুপ। বিদ্যুৎবিভাগের উপর কৃতজ্ঞতায় মনটা ভরে উঠল। প্রতি সন্ধাবেলায় সময় করে এবং সময় নিয়ে কারেন্ট চলে যেত। ব্যস, পড়া ফেলে বাইরে এসে বসা। চাঁদের আলোতে মাটিতে পাটি বিছিয়ে মা বাবা বসে।পাশে আমার বড় বোন,যে সবে মাত্র গান শিখতে শুরু করেছে এবং অত্যন্ত উৎসাহী গায়িকা হিসেবে পারিবারিক পরিমন্ডলে আত্ম প্রকাশ করেছে,সে কারোর ফরমায়েসের অপেক্ষা না করেই বাজখাই গলায় গান ধরেছে'খর বায়ু বয় বেগে...'।তখন তার স্টক সীমিত ছিল--একটা গানই গাইতে পারত।চাঁদের আলোর এমনি মায়া, সেই দুর্বিষহ গান কেও মধুর মনে হত।
তারপরের ইতিহাস খুব সরল। আমি প্রায় প্রতিদিন অপেক্ষা করতাম প্রেমে পড়ার। প্রতিদিন ই কিছুই ঘটত না।আমি মন ভার করে মাস্টার্স দিয়ে বুয়েটে চলে এলাম এম ফিল নামের একটা কিম্ভুত জিনিস করতে। প্রেমের অপেক্ষা করতে করতে এক সময় চাকরী পেয়ে গেলাম। তখন আমি নিশ্চিত হলাম, এই জীবনে আমার প্রেম হবে---বিয়ের পর।
ঠিক তখুনি,এক রাজকন্যা আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিল। হঠাৎ করেই আমার সকাল গুলো বদলে গেল, বদলে গেল দুপুর বিকেল সন্ধ্যা। রাস্তায় বাসে রিক্সায় আমি বিনা কারনে হাসিমুখে বসে রইতাম।
তখন চাঁদ হয়ে উঠেছিল আমাদের দুজনের সখা। আমরা দু'জন থাকতাম দেশের দুই প্রান্তে। রোজ আমাদের দেখা হত চাঁদে। আমরা দু জন সময় করে ঠিক একই সময়ে ছাদে উঠতাম, তাকাতাম চাঁদের দিকে। জানি জানি, খুবই ঢলঢলে প্রেম কাহিনী হয়ে গেছে।কিন্তু এই রকম sillyness তখন বিস্ময়কর রকম রোমান্টিক মনে হত।
যাইহোক,'উচ্চ শিক্ষার্থে' আমার দেশ ছেড়ে আমেরিকায় এসে পড়তে হল। এবং প্রায় আট বছর পর আমার রাজকন্যা আমার কাছ থেকে বিদায় নিল।
এখন আমার দিন গুলো--আর সব দিনের মত। কেবল রাত আমি সহ্য করতে পারিনা। কারন মাঝে মাঝেই বেহায়া চাঁদ আসে,সারাটা আকাশ মোমের আলোয় ভাসিয়ে দিয়ে।শহরের সমস্ত গলি ঘুঁজি খুজে আমাকে সে বের করে আনে। আমি আমার দীর্ঘশ্বাসের মত লম্বা রাস্তায় নির্জন হয়ে থাকি।
4 comments:
আপনার মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ। আপনাকে নিরাশ করতেই হচ্ছে। আমার মত বুড়ো বয়সে PhD করতে কেবল কলিজার জোর থাকলেই চলবে না, যথেষ্ট পরিমান বোকাও হতে হবে। আমার মনে হয় না যে এই রকম খুব বেশি পাওয়া যাবে।
আবারো, ধন্যবাদ।
দুঃখিত।
আসলে অনেক দিন পর পর এইখানটায় আসি।
আমার বিষয় পদার্থবিদ্যা। আপনার?
এই বিষয়ে PhD করতে গিয়ে নানাবিধ দুর্নামের সাথে 'অপদার্থ' নামটি ও জুটে গিয়েছে।
ভালো থাকবেন। কথা হবে।
ওহ ভালো কথা, আপনি কি 'সচলায়তন' এ আছেন?
Post a Comment