Sunday, October 26, 2008

নিঃস্বপ্ন

এই দেশটায় আসার পর যতগুলো গুরুত্বপুর্ণ ঘটনা ঘটেছে আমার জীবনে, তার মাঝে 'নিঃস্বপ্ন' হয়ে যাওয়াটা অন্যতম।
আমি স্বপ্ন ভঙ্গের কথা বলছি না। আমি স্বপ্নহীনতার কথা বলছি।

দেশে থাকতে আমার বেশ কিছু স্বপ্ন ছিল। এটা সেটা করার। এটা সেটা হবার।

এখানটায় আসার পর আমি আর স্বপ্ন দেখিনা।

মাঝে মাঝে মরার মত ঘুম আসে। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে চোখ ফুলিয়ে দেই। কিন্তু কোন স্বপ্ন দেখিনা।
প্রবল ঘুমের পর জেগে উঠে মনে হয় হাজার বছর ধরে আমি জেগে আছি। আমি আমার চেনা মানুষদের মাঝে ভান ধরে বসে থাকি।
কেবল হাসি, কেবল ঠাট্টা। একের পর এক অক্লান্ত ঠাট্টাবাজীতে নিজেই নিজেকে ফতুর করে দিই। তারপর সব কোলাহল ফুরোলে ঘরে ফিরি নিজের টুকরো গুলো কুড়িয়ে নিয়ে।

দিনের পর দিন এ পৃথিবীটা খয়েরী হয়ে যাচ্ছে আমার চোখের সামনে। রাস্তা ঘাটে দেখি--কত মানুষ হা হয়ে তাকিয়ে দেখছে হেমন্তের আবির্ভাবে রঙ্গীন হয়ে ওঠা গাছের শোভা। পথ জুড়ে পড়ে আছে কত বাহারী রঙের পাতা। আমি ক্লান্ত চোখে তাকাই।
শুধু ওদের ঝরে পড়ার সাথে আমার কোথায় যেন মিল খুঁজে পাই।

মাঝে মাঝে নিজেকে খুব করে বকে দিই। আমার এসব আসলে দুঃখ বিলাস। হবেও বা। ঠিক এই মুহুর্ত্তে কত শত লোক তাদের জীবন বিপন্ন করছে, কত শত শিশুর জীবন বিকিয়ে যাচ্ছে বুলেটের দামে। আর আমি? নরম গদিতে ঠেস দিয়ে বসে লিখছি আমার স্বপ্নহীনতার কথা।

ফক্কুলের সাথে মাঝে মাঝে কথা হয় রাত জেগে। একে অন্যের ঘা চেটে চেটে দিই। একসাথে দুই জনেই দীর্ঘশ্বাস ফেলি। ঠিক কখন আমরা হারিয়ে গেলাম মুল স্রোত থেকে? ঠিক কখন আঁধি এসে নিয়ে গেল পথ ভুলিয়ে? এ সকল হাবিজাবি ভাবি। শেষে দুই জনেই একমত হই---আমাদের দিয়ে আর কিস্যু হবে না।

ফক্কুলের তাও একটা বড় কাজ শেষ হয়েছে-পি এইচ ডি। আমার এখনো ঝুলছে। কতদিন ঝুলে থাকতে পারব কে জানে।

আমার করা হল না কিছুই।

আমার কথা ছিল বুড়ো বাবার হাত ধরে টুকটুক করে রাস্তা পার করে দেয়া। আজ হয়ত পথের মাঝে নাম-না-জানা কেউ এসে আমার বাবার হাত ধরে----ধীরে ধীরে আমার বাবা পার হয় রাস্তা। ঝুকে ঝুকে বারবার ধন্যবাদ জানায়। আমার কথা ছিল পহেলা বৈশাখের সকালে মায়ের সাথে সংস্কৃত কলেজের আমতলায় যাওয়া। একরাশ রোদ্দুরের মত কচি কচি কন্ঠে বেসুরো রবীন্দ্র সঙ্গীত শুনে মাথা দোলানো। কথা ছিল, বোনটা গানের সিডি বের করলে তাতে বাজবে আমার তবলা।

আজ আমার বাবা কে পথ পার করিয়ে দেয় অচেনা কোন হাত।
আজ আমার মা আর পহেলা বৈশাখের দিন মনে রাখে না।
আমার বোনের সিডিতে নাম না জানা এক তবলিয়া বাজিয়ে যায়।

আর আমি?

হাজার হাজার মাইল দূরে আমার অনাগত দিনের মত অন্ধকার শীতল রাতে পথের ধারে ঘাড় নীচু করে বসে থাকি। দূরে কোথাও কিছু সুখী মানুষের স্বর শুনি। প্রানপনে চোখ বুজে ভাবার চেষ্টা করি---এসব ঘোর মিথ্যে। আমি চোখ খুললেই পৌছে যাব----

কোথায়? কে জানে।

দিনের পর দিন নি;স্বপ্ন থেকে থেকে বন্ধ্যা হয়ে আসে ভবিষ্যত। আমি এমন এক পথে দাঁড়িয়ে আছি---এ পথে না যায় এগুনো, না যায় পিছানো।

আমার তুমুল প্রেম যার সাথে----সেই পদার্থবিজ্ঞান জানিয়েছে অনেক আগে---আমি তার যোগ্য নই। তাঁকে ঘিরে কত সুদর্শন মসৃন চামড়ার পুরুষের ভীড়। আমি অ-নে-ক দূর থেকে উঁকি দিয়ে দেখতে পাই। তাঁকে ঘিরে চলেছে দেবী বন্দনা।


আমার কেবলি মনে হতে থাকে---মানুষের এই বিশাল কর্মযজ্ঞে আমি এক অপ্রয়োজনীয় কাঠের টুকরো। কোন ফাঁকেই আমাকে গোজা যায় না। কোন কিছুরই আমি অংশ হতে পারি না।

না আমার স্বজনের।
না বিজ্ঞানের।
না এই বিশ্বের।

কি যে অপ্রয়োজনীয় এই বেঁচে থাকা!

4 comments:

Anonymous said...

আমারও একই অবস্থা! ২০০৮ এর শেষ দিনে তীব্র অপরাধবোধে আচ্ছন্ন, কিচ্ছু না করেই পার করে দিলাম একটা পুরো বছর!!!

Anonymous said...

নিজেকে খুঁজে পেলাম...

Anonymous said...

"নি:স্বপ্ন"র পর চারমাস পেরিয়ে গেল। এখানে আর নতুন লেখা নেই :(

monsoon_mist said...

এত মন খারাপ করলে কি চলে! এরি নাম বেঁচে থাকা। আপনার লেখা সচলায়তনে পরেছি - আপনি নিরাশাবাদী নন মোটেও। এখানে এত চাপ নিয়ে পড়া সোজা কথা নয়, আমি নিজেই হাবুডুবু খাচ্ছি। ভাল থাকার চেষ্টা করবেন, এই আশাই রইল।

শুভেচ্ছা।