Monday, April 13, 2009

এ পথে আমি যে গেছি বার বার

অনেক আগে, মন ভালো করার দায়িত্ব দিয়েছিলাম একজন কে।
তারও আগে, মন ভালো করার দায়িত্বে ছিল একটা পাহাড়।
মন খারাপ হলেই গিয়ে বসে থাকতাম তার চুড়োয়।

আমার শাবিপ্রবির জীবনটা নানা টানা পোড়েনের মাঝে কেটেছে। শাবিপ্রবি তে এসে আমি প্রথমবারের মত পৃথিবীর পথে একা নেমেছিলাম। তার আগে 'পৃথিবীর পথে' আর 'পৃথিবীর পাঠশালায়' ঘোরা হয়েছে ম্যাক্সিম গোর্কির হাত ধরে। বইয়ের পাতায় পড়া সংগ্রামের সাথে যাপিত জীবনের সংগ্রামের কোনো মিল ছিল না। গোর্কি পড়ে পড়ে মনে হয়েছিল, জীবনের সকল কষ্টের মুখ আমার চেনা হয়ে গেছে। আমাকে আর চমকে দেয়া সহজ নয়। নিতান্তই অপোগন্ড ছিলাম।

আজ এত বছর পর, তাকিয়ে দেখি---এখনো অপোগন্ডই রয়ে আছি।

শাবি-তে আমাকে নানান কষ্টের মধ্যে পড়তে হয়েছিল। খাওয়ার কষ্ট, নাওয়ার কষ্ট। আশাভঙ্গের কষ্ট। নিজেকে চেনার কষ্ট। কত কি!
সে সময় আমার অনেক 'বন্ধু' ছিল। কিন্তু বন্ধু তেমন কেউ ছিল না। কেউ ছিল না যার কাছে গিয়ে বলতে পারি, জানো ভাই, আমার বড্ড কষ্ট হচ্ছে, কিন্তু জানিনা কেন। আমি তোমার কাছে একটু বসি ? তুমি কি কিছু একটা বলে আমার মন ভাল করে দেবে?

ক্রমশ দলছুট হয়ে যাচ্ছিলাম। দেখলাম---আমার দুঃখের কথা শোনার অবসর কারো নেই।তারচেয়েও বড় কথা-- আমারও বলার মত কোন দুঃখ নেই, অথচ বুকে দলা পাকানো কান্না। সবাই আমার হাসিমুখ দেখতে চায়। মন ভার হয়ে থাকলে, মুখে ছাপ পড়ে সবার আগে। আমার মুখ দেখেই হয়ত বোঝা যেত যে মন খারাপ। কেউ তখন কাছে ঘেসত না।

অথচ তখন সামান্য একটু স্নেহের কথা, প্রশ্রয়ের কথা শোনার জন্যে নিদাঘ কালের পিয়াসী চাতক হয়ে থাকতাম। সবার সাথে ভীড়ে গিয়ে মন ভুলিয়ে রাখার চেষ্টায় আমি ক্রমশ ক্লাসের ভাঁড়ে পরিনত হলাম। সব সময় হাসি। সব সময় উচ্ছাস। সব সময় গান-বাজনা। ক্লাসের ফাঁকে টেবিল চাপড়ে গান গাওয়া----বন্ধুদের কাছ থেকে পিঠ চাপড়ানো পাওয়া। সেই সম্বল করে রাতে ঘরে ফেরা।

দিনের পর দিন সঙ সেজে থেকে থেকে, মুখে রং মেখে থেকে থেকে ভুলে যাচ্ছিলাম আমার নিজের মুখ।

কিসের যে বিপন্নতা বোধ আমাকে আচ্ছন্ন করে রাখত---সেটা আজো আমার জানা হয়নি। শুধু মনে রয়ে গেছে সেই তীব্র হতাশার আঁচড়্গুলো।

সেই সময় আমি তাকে খুঁজে পাই।

এক বিকেলে একা একা হাটতে বেরিয়ে অনেক দূরে চলে গিয়েছিলাম। সূর্য তখন সারা দিনের ক্লান্তি মুছে ঘরে ফেরার জন্যে তৈরী। ঘরে ফেরার খুশিতেই হয়ত মুখখানা তার বড় উজ্জ্বল। আমি সূর্য দেখতে দেখতে, সবুজ ঘাসের মাঝে হারাতে হারাতে এক সময় হারিয়ে গেলাম। ঠিক তখুনি আমার সামনে এসে দাঁড়াল সে। চারদিকে ছোট ছোট টিলা। তাদের বুকের মাঝে আগলে রেখেছে ছোট্ট একটা টিলা। সারা চরাচরে আর কেউ নেই যেন। শুধু আমি আর সে।

আমি খুব সাবধানে তার গায়ে হাত রাখলাম। সবুজ ঘাসের গালিচা বিকেলের কুয়াশার গন্ধ বুকে মেখে বড় আদুরে হয়ে ছিল। আমি হাত রাখতেই সে একেবারে বুকের মাঝে টেনে নিয়ে গেল। আমি মন্ত্রমুগ্ধের মত চলে গেলাম তার কাছে। উঠে গেলাম তার চূড়োয়। চারিদিকে কেউ নেই। কিছু নেই। আদিগন্ত বিস্তৃত ফসলের মাঠ। কুয়াশার চাদরে ঢাকা ঘন নীল কিছু পাহাড়। আর মাঝখানে আমি।

আমি স্তম্ভিত হয়ে ভাবছিলাম---এতদিন আমি এখানে আসিনি কেন? তখন সন্ধ্যে হয়ে গেছে। সেই ছোট্ট পাহাড় থেকে আমার নামতে ইচ্ছে করছিল না। বহু বছর পর প্রথমবারের মত একটা অদ্ভুত অনুভুতির সুর বাজছিল মনে। অনেক পরে জানতে পেরেছি---ঐটেই ছিল শান্তির অনুভুতি।

এরপরে যতবার আমার শান্তির দরকার হয়েছে---আমি ছুটে গেছি তার কাছে।
আমার বন্ধুরা আমাকে ছেড়ে গেছে, আমি চলে গেছি তার কাছে।
অনেক দিন ধরে যাকে কিছু কথা বলব বলে ভেবে রেখেছিলাম, ভেবে রেখেছিলাম পৌষ-সংক্রান্তির সকালে যাকে বলব আমার ছোট্ট একটা গোপন কথা------ জীবনের বাকী সব উৎসবে শুধু তার হাত ধরে থাকতে চাই, খুব কাছের এক বন্ধুর কান্না দেখে, তাকে সে কথা না বলে চলে এসেছি। চলে গেছি আমার পাহাড়ের কাছে। এরপর যতবার তাদের দু'জনকে একসাথে দেখেছি, ততবার আমার পাহাড়ের কাছে ছুটে গেছি। চুপ করে বসে কাটিয়ে দিয়েছি সারাটা বিকেল।কখনো অজান্তে ভেসেছি চোখের জলে। আমার সে পাহাড় সব দেখেছে। কিন্তু একবারও বকে দেয়নি। একবারও আমার কান্না দেখে হাসেনি। একবারও বলেনি, ছিঃ তুমি না পুরুষ মানুষ, ছেলেদের যে কাঁদতে হয়না। একবারও সে বলেনি---দুঃখ করো না, এরচেয়ে ভাল কত মেয়ে তুমি পাবে---! নাহ, কোনও মিথ্যে স্তোকবাক্য সে শোনায়নি। বরং সে বলেছিল, তুমি যা হারিয়েছ, তারজন্যে দুঃখ করো। প্রতিটা মানুষ অমুল্য ধন। কাউকে হারালে---তুমি এক অনন্যসাধারন কেই হারাও। তাই দুঃখ কর।

আমি যখন তাকে আঁকড়ে ধরে শুয়ে থাকতাম---আমার সকল দুঃখ সে যে শুষে নিত। আমার খুব কষ্টে জমানো কিছু সুখের গল্প, আমার ভান্ডার উপচে পড়া দুঃখের গল্প---- সব কিছুর শ্রোতা হয়েছিল সে।

এক সময়, শাবি-র দিন শেষ হয়। চলে যেতে হয় অন্য কোন খানে। জীবন তার নানান শিকে বিদ্ধ করে আমাকে তপ্ত আঁচে ঝলসে নেয়।
সামান্য শ্বাস ফেলার সুযোগ পেলেই চলে যেতাম সিলেটে। সেখানে গুটিকয় মানুষ আর একটা পাহাড় আমার অপেক্ষায় থাকত। প্রতিবার তার সাথে দেখা করতে যাবার আগে, ঠিক প্রিয়া-অভিসারে যাবার মত দমবন্ধ করা একটা অনুভুতি হত। গিয়ে তার দেখা পাবো তো? খালি মনে হত---আমার একমাত্র সুখের এই স্থান যদি কেউ কেড়ে নেয়। কোন লোলুপ-লুম্পেন ঠিকাদারের শাবলের নীচে হয়ত
সে হারিয়েছে তার ঐশ্বর্য, তার যৌবন, তার কুমারীত্ব। প্রতিবার গিয়ে তার দেখা পেতাম----আর কেন জানি অপার কৃতজ্ঞতায় মনটা ভরে উঠত। সে আছে, সে আছে---সে এখনো আছে!

তারপর বহুদিন পর দেশ ছাড়ার ডাক এল। আমি সবার কাছ থেকে বিদায় নিলাম। সিলেট ছাড়ার আগের দিন সন্ধ্যায় মা কে বললাম, মা আমি আমার এক বন্ধুর সাথে দেখা করতে যাই, বিদায় নিয়ে আসি। মা জিজ্ঞেস করে কোন বন্ধু। আমি বলি আমার পাহাড়ের কথা। ভেবেছিলাম মা হয়ত হেসে উঠবে অথবা হয়ত বিরক্ত হবে আমার এইসব পাগলামীতে। কিন্তু মা সেসব কিছুই বলল না। মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, যা দেখা করে আয়!

সে সন্ধ্যায় আমি বসেছিলাম আমার পাহাড়ের কাছে। কেউ কোন কথা বলিনি। কেউ কাউকে বিদায় বলিনি।

এক হাজার দিন শেষে যখন ফিরি দেশে----তার সাথে দেখা করতে ছুটে গেছি আমি। প্রচন্ড উৎকন্ঠায় দেখেছি শাবির ক্যাম্পাসের শ্রীবৃদ্ধি। ঠিকাদারদের শাবলের নীচে চলে গেছে কত কত পাহাড়, কত কত মাঠ---আমার বন্ধু কি আছে? কোনভাবে সে কী বাঁচতে পেরেছে??

আমাকে অবাক করে দিয়ে, সে দেখা দিল হাসিমুখে। আমার মতই তারো বয়েস হয়েছে দেখলাম। আমার মতই তার মাথায় পড়েছে টাক। আর আমার মতই সে রয়ে গেছে পরস্পরের বন্ধু হয়ে। তার গায়ে হাত বুলাতে বুলাতে জিজ্ঞেস করেছি, কী রে পাগলা কেমন ছিলি? সবার নজর এড়িয়ে ছোট্ট একটা চুমু দিয়ে এসেছি তার গায়ে। এবার ফেরার আগে কিনেছি একটা ছোট্ট তাবিজ। সেইখানে ভরে নিয়ে এসেছি আমার বন্ধুর পদধুলি। খুব মন খারাপ হলে আমি সে তাবিজ আমার গলায় ঝুলিয়ে দেই। আমার বুকের কাছটায় বসে বন্ধু বলে----আমি আছি, তুই চিন্তা করিস না।

এর মাঝে কত কী হয়ে গেছে আমার এই নগন্য জীবনে। কত বন্ধু বদলে গেল ঋতু বদলানোর আগেই। কত নতুন মুখ ভীড় জমালো মনের জানালায়। এর মাঝে কোন একজনকে কিছু সময়ের জন্যে মন-ভালো করার দায়িত্বটাও দিয়ে ফেলেছিলাম,ভুল করে। ভুল করে। ভুলে গিয়েছিলাম হাজার হাজার মাইল দূরে আমার এক বন্ধু দীর্ঘ দিবস দীর্ঘ রজনী জেগে থাকে আমার দুঃখ গুলো বুকে নিয়ে। সে কখনও আমাকে ফিরিয়ে দেয় নি শূন্য হাতে।

এখনো যতবার বুকের পাড় ভাঙ্গে, আমার ছুটে যেতে ইচ্ছে হয় আমার সে বন্ধুর কাছে---ইচ্ছে হয় তাকে জড়িয়ে ধরে বলি,বন্ধুরে আর যে পারিনা-----আর তো পারিনা-----


বন্ধু, তুই ভাল থাকিস-------

7 comments:

Anonymous said...

‘What we can not speak about, we must consign to the silence’

Tareque Aziz said...

Very True!
And I am still wondering who you are....!!!

যাযাবর said...

এমন করে লিখেছেন, বুক টা মোচড় দিয়ে উঠলো কেমন!

Tareque Aziz said...

লেখাটা আপনার মন খারাপ করে দিয়ে থাকলে, আন্তরিক ভাবে দুঃখিত।

ভালো থাকবেন!

শাফ্‌ক্বাত said...

লেখা মন খারাপ হলে দুঃখিত হওয়ার কিছু নেই তারেক, আমরা মন খারাপকে মাঝে মাঝে উপভোগ করি। কথাটা কেমন যেন শোনায়, কিন্তু মন খারাপকে নিতান্ত মেনে নেওয়ার চাইতে তাকে 'সাগ্রহে' বরণ করে নিতে কয়জন পারে? আপনার এই লেখাটা পড়ে মনে হয় 'মন খারাপেরও' দরকার আছে জীবনে। দরকার আছে নিজের সাথে একা একা সময় কাটানোর, একাকীত্বকে উপলব্ধি করার।

আপনার লেখা পড়তে বেশ ভাল লাগছে। মন টা খারাপ হচ্ছে সেটা আপনারই কৃতিত্ব, নিজের অনুভুতিকে ছড়িয়ে দিতে পারলেন। আপনার সেই পাহাড় বন্ধুকে ধার দিতে পারলে জানিয়েন, আমারো অমন একজন দরকার।

আপনি ভাল থাকবেন।

ভূ-কণ্যা said...

আপনার এই বন্ধুর নাম যদি হয় এরশাদ টিলা...বা এটি যদি হয় তার আশে পাশের কোনো একটি টিলা, তাহলে বলবো, সে এখনও বেচেঁ আছে! কার সাথে কিসের এত অভিমান আপনার ? পাহাড় আকড়েঁ বেচেঁ থাকতে চান? আমি হলে, সেই পাহাড়ের কাছে একটা কুড়েঁ ঘর বানিয়ে আমৃত্যু পাশে থাকতাম !! চলে আসুন দেশে ! চলে আসুন বন্ধুর পাশে!

http://www.somewhereinblog.net/blog/bhukonna

Tareque Aziz said...

bhukonna, আপনার মন্তব্যের জন্যে ধন্যবাদ।
আমি এখনো বুকে আশা পুরে রাখি--- কোন একদিন বন্ধুটার সাথে সময় কাটানোর সুযোগ হয়ত হয়ে যাবে---

আপনার জন্যে অনেক শুভাশীষ রইল!