Sunday, August 30, 2009

শাপমোচন

আমার বন্ধু-ভাগ্য খুব ভাল।
কোথা থেকে জানি চমৎকার চমৎকার সব বন্ধু জুটে যায়।

আমার বন্ধু ভাগ্য আবার খুব খারাপও।
কেমন করে জানি সেইসব চমৎকার বন্ধুরা এক সময় হাওয়ায় উবে যায়।

সাধারণ মানুষের চাইতে আমি মনে হয় একটু বেশি স্বার্থপর। তাই হয়ত বন্ধুগুলো এক সময় আমার পাশে আর থাকতে চায় না। আমি দুই হাত ভরে ওদের কাছ থেকে নিয়েই চলি। ফিরিয়ে দেবার কথা মনেও হয়না।

কে থাকবে এমন একজন লোকের সাথে? আমি নিজেই থাকতাম না।

ইদানিং, জানিনা বয়েসের কারণেই কিনা, খুব করে মনে পড়ে হারিয়ে ফেলা সেই হীরের টুকরোগুলোর কথা।
সবচাইতে পুরোনো যে বন্ধুটির কথা মনে পড়ে---তার নাম জয়নাল। আমার ক্লাস সিক্সের বন্ধু। তখন আমরা নরসিংদীতে থাকি। জয়নাল ছিল ব্রাহ্মন্দী কে কে এম গভর্মেন্ট হাই স্কুলে আমার সহপাঠি। হ্যাংলা-পাতলা শরীর। একটা বেমানান রকমের বড় মাথা। সে মাথায় অস্বাভাবিক রকমের উজ্জ্বল দুটো চোখ। এইটুকুই কেবল মনে আছে। জয়নাল খুব চুপচাপ রকমের ছেলে ছিল। ক্লাসে পেছনের বেঞ্চে যারা বসে, তারা সাধারনতঃ যে রকম মার-কাটারী হয়---জয়নাল ছিল একেবারেই তার উলটো। ঐ স্কুলে আমি দুই বছর কাটিয়ে ছিলাম। ঐ সময়ে আমার বন্ধু মহলে যারা ছিল তারা সবাই আমার মতই ছিল। আমার মতই চঞ্চল। আমার মতই ভীতু। আমার মতই সচ্ছল। জয়নাল আমাদের মত ছিল না। তাই জয়নাল আমার বন্ধু ছিল না। গোটা দুই বছর নরসিংদীতে কাটানোর পর আমরা যখন আবার বদলী হচ্ছি তখন জয়নাল একদিন এসে আমাকে বলল, আমাকে তার নাকি খুব ভাল লাগে। এই দুই বছরে জয়নালের সাথে আমার কথা হয়েছে বড়জোর তিন-চার বার। এমন একজন যখন হঠাৎ করে এসে বলে----আমাকে খুব পছন্দ করে, তা উত্তরে কী বলতে হয়?

আমার জানা ছিল না।

আমি তাই কিছু বলি নি।

জয়নাল কিছুখন চুপ থেকে বলেছিল, তোমাদের নতুন জায়গাটার ঠিকানা দেবে? আমি তোমাকে মাঝে মাঝে চিঠি দেব। আমি বলেছিলাম, আমার ঠিকানাটা মুখস্থ নেই। কাল জেনে এসে জানাব।

পরের দিন দুপুরে ট্রেনে চেপে রওনা সিলেটের পথে। আমার বাবার নতুন বদলীর জায়গা। নতুন জায়গায় যাবার আনন্দে বুঁদ হয়ে থাকা আমার মনে জয়নালের কোন স্থান ছিল না। তাকে ঠিকানা না দেবার জন্যে কোন অপরাধবোধও ছিল না।

সিলেটে এসে যখন খুব জমে গিয়েছি আত্মীয়-স্বজন আর বন্ধু-বান্ধবের ভীড়ভাট্টায়---তখনি এক দুপুরে পিয়ন বাসায় একটা চিঠি নিয়ে এল। আমার চিঠি। লিখেছে জয়নাল।

আমি জানিনা সে কী করে আমার ঠিকানা জোগাড় করেছিল।কিন্তু এইটা জানি---সে চিঠি পেয়ে খুশি হবার বদলে
আমি কেন জানি খুব বিরক্ত হয়েছিলাম। কিছুটা ভয়ও পেয়েছিলাম।জয়নালে সে চিঠিতে উল্লেখযোগ্য কিছুই ছিল না। প্রচুর বানান ভুলের মাঝে সে জানিয়েছিল, আমার জন্যে তার মন পুড়ে। সে চিঠির কোন উত্তর আমি দেইনি।
মাস খানেক পরে জয়নালের আরেকটা চিঠি আসে। সেখানে সে জানায়---তার মন খুব খারাপ। নাহ, আমার জন্যে নয়। তার পাঁচ বছর বয়েসী ভাইটা মারা গেছে। ঘরের ছাঁদ থেকে ফ্যান খুলে পড়েছিল ওর উপর। এইটুকুই খবর।

আমার মনে আছে, আমি সেই চিঠিটার উত্তর দিয়েছিলাম। আমি তখন জানতাম না কী করে মানুষকে দুঃখে সান্ত্বনা দিতে হয়।তাই মা কে জিজ্ঞেস করেছিলাম। মা বলে দিয়েছিল। আমি লিখে দিয়েছিলাম।

জয়নাল আর আমার সাথে যোগাযোগ করেনি।

তারপর বহু বছর কেটে গেছে। জয়নালের চেহারাটা আস্তে আস্তে আমার মন থেকে মুছে গেছে। মুছে যায়নি শুধু সেই উজ্জ্বল চোখ দুটো---আর কান্না ভেজা চিঠিটা।সেই চিঠিটার কিছু কিছু অক্ষর পানিতে ভেসে গিয়েছিল।

জয়নাল কি কাঁদছিল চিঠিটা লেখার সময়?
জানিনা, জানা হয়নি----

আমি জানিনা জয়নাল আমার উপর অভিমান করেছিল কি না। আমি জানিনা জয়নাল আমাকে কোন অভিশাপ দিয়েছিল কি না। কারণ এর পর থেকে আমি বারবার বন্ধু পেয়েছি--কিন্তু হারিয়েছি তারচেয়েও বেশিবার। যাদেরকেই বন্ধু বলে কাছে টেনেছি---কিছুদিন পর কোন এক কারণে তারা সরে গেছে আমার কাছ থেকে। আমার দিক থেকে যথাসাধ্য চেষ্টা সত্ত্বেও সেই সম্পর্কগুলো আর জোড়া লাগেনি। বারবার প্রিয় বন্ধু হারানোর বেদনায় ভাসতে হয়েছে আমাকে। যতবার আমার কোন প্রিয়বন্ধু আমাকে ছেড়ে চলে গেছে--ততবার আমি টের পেয়েছি বিশাল দুটি চোখে কে যেন অবজ্ঞা ভরে, করূণা ভরে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।আমি টের পেয়েছি কী এক অভিশপ্ত জীবন আমি বয়ে চলেছি।

জয়নাল আমাকে অভিশাপ দিয়েছে। আমি তাই এক জয়নাল হয়ে উঠেছি--যাকে হেলা ভরে ফেলে দেয়া যায়, ভুলে যাওয়া যায়,ঠিকানা দেব বলে না দিয়ে চলে আসা যায়।

মাত্র কিছুদিন আগে আমাকে আবার এক পরম মিত্রকে হারাতে হল। খুব খুব ভাল একটা বন্ধু ছিল। আমার সকল আহ্লাদ, সকল অনুযোগ, সকল স্বপ্ন আর স্বপ্নভঙ্গের কথা শোনার সেই একমাত্র লোক ছিল। তার সান্নিধ্যে বড় নিরাপদ বোধ করতাম। ক্ষনিকের ভুলে মনে হয়েছিল--হয়ত আমার সে শাপ মোচন হয়েছে। ভেবেছিলাম, এবার হয়ত আর বন্ধু হারানোর বেদনায় ভুগতে হবে না।

ভুল ভেবেছিলাম।

ঠিক যখনি স্বস্তিবোধ করতে যাচ্ছিলাম, ঠিক তখনই আঁধি এসে নিয়ে গেল তাকে।
আমাকে রেখে গেল একা সুনসান পথের ধারে।

কেন জানি নিজেকে Ancient Mariner এর সেই মৃত এলবাট্রস গলায় ঝুলিয়ে থাকা অভিশপ্ত নাবিক মনে হয়।
সে নাবিকের শাপ মোচন হয়েছিল---আমার হবে কি??

3 comments:

Anonymous said...

মনটা খারাপ হলো পড়ে... দাদা... ...



নুশেরা

saif said...

ভাগ্যিস, আমি আপনার অনুজ, বন্ধু হইলে দুরে সরে যেতে হত :D, লেখাটা যেন ছবির মত জ্বলজ্বল করে উঠল, আর বেচারা ক্ষুদা নিপীড়িত চকচকে চোখের জয়নালের জন্যে খুব খারাপ লাগল। আসলে ঐ বয়সে শিশু-কিশোরেরা কেন যেন বেশ স্বার্থপর থাকে, মানবিক গুনাবলীর প্রকাশ তখনও হয় না।

শাফ্‌ক্বাত said...

আমি আপনার এই লেখাটা পড়ে খুব আবেগতাড়িত হয়েছি জানেন? আপনার সাথে নিজের মিল পেয়েছি আবার নিজেকে ভাগ্যবানও মনে করছি। কারণ আমিও আপনার মত বন্ধুদের কাছ থেকে কেবল নিয়েই গিয়েছি, দেইনি কিছুই। এমনকি যোগাযোগ ছিন্ন করেছি আবার যোগাযোগ করেছি স্বার্থের প্রয়োজনেই। কিন্তু আমার এত স্বার্থপরতা সহ ওরা আজো আমাকে ওদের মনের সেই একই জায়গায় বসিয়ে রেখেছে।

কী আশ্চর্য জানেন, যার জন্য আমি স্বার্থহীন ছিলাম আজীবন, নিজের স্বকীয়তা পর্যন্ত ধূলোয় বিকিয়ে দিয়েছি তাকে খুশী করবো বলে, সে কখনও খুশী তো হলোইনা বরং সে-ই আমাকে সুযোগ-সুবিধা মত ব্যবহার করে প্রয়োজন শেষে ছূড়ে ফেলে দিয়েছে বারবার। তবু বারবার আমি ফিরে ফিরে তার কাছে গিয়েছি।

মানব-চরিত্র কত অদ্ভূত!!

-শাফ্‌ক্বাত