Thursday, June 9, 2011

আমার রুবি রায়

আমার ছোটবেলাটা কেটেছিল এই পৃথিবীর সবচাইতে সুন্দর বাড়িটায়!

সিলেটের এম সি কলেজের প্রিন্সিপালের বাংলো আমার দেখা এই পৃথিবীর সবচাইতে চমৎকার বাড়ি।
ছোট্ট একটা টিলার উপর একটা বিশাল একতলা বাড়ি। বাড়িটা ঘিরে কত কত নাম-না-জানা গাছের সারি। একটা ছোট্ট পাকদন্ডী টিলাটার গা বেয়ে ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে উঠে গেছে বাড়িটার দিকে। নিশুত রাতে সেই পাকদন্ডী বেয়ে হাঁটতে বেরুলে মাঝে মাঝেই গা শিরশির করে উঠত। দারুণ গ্রীষ্মের দুপুরে বাড়িটার প্রশস্ত বারান্দায় অলস দুপুর ঘুমুতে আসত। বারান্দা থেকে হাত-বাড়ানো দূরে একটা পেয়ারা গাছ। সেটা ছাড়িয়ে গেলে কেবল ফুলের বাগান। কত কত ফুল! সন্ধ্যে বেলাটা ছিল আমার সবচাইতে প্রিয়। পশ্চিমের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে সূর্যদেবকে বিদায় জানাতাম। দেখতাম সারা দিনের ক্লান্তি সাথে নিয়ে সূর্য দূরের ঐ মাঠটার পেছনের নীল কুয়াশার চাদরে ডুবে যাচ্ছেন। শীতের দিনের সকাল-বিকেল দুইটাই ছিল অসাধারণ। সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে পড়তে বসার আগে এক ছুটে বাড়ির বাইরে যাওয়া। বারান্দায় স্যান্ডেল রেখে এসে খালি পায়ে ভোরের শিশির ভেজা ঘাসে পা রাখা। মনে হত ঘাসেরা যেন ছোট ছোট হাত বাড়িয়ে আলতো করে জড়িয়ে ধরছে আমার পায়ের পাতাটাকে পরম মমতায়। বিকেলে দেখতাম পাহাড়ের চূড়া থেকে সূর্যের অস্তাগমন। পাহাড়ের চূড়া থেকে যে সূর্যাস্ত না দেখেছে--তাকে বলে বোঝানো যাবে না সেই অপার্থিব সৌন্দর্যের কথা।

সেই বাসায় যখন আমি আমার স্বপ্নের মত দিন কাটাচ্ছি--তখন একদিন আমার 'সুখের ঘর' 'অনলে পুড়িয়া গেল'। একটু পরিষ্কার করি বিষয়টা। মহানায়ক উত্তমকুমারের তিরোধান উপলক্ষে একটা ক্যাসেট বেরিয়েছে তখন। নাম খুব সম্ভবত 'মহানায়ক উত্তমকুমার স্মরণে'। উত্তম অভিনীত সব ছবির উত্তম-মধ্যম-অধম গান আর কিছু কিছু সংলাপ নিয়েই ক্যাসেটটা। অতি উত্তম! কিন্তু আমার সুখের ঘরে আগুন লাগল কী করে? আগুনটা লাগল ক্যাসেটের 'এ' পিঠের শেষে এসে পিঠ ঠেকতেই! যারা আমার মত ক্যাসেট শুনে শুনে বড় হয়েছেন (এখনকার পুলাপানরা তো কথায় কথায় সিডি/এম্পি৩ প্লেয়ার ঝেড়ে দেয়) তারা জানেন প্রায় সব ক্যাসেটের শেষের দিকে একেবারে অবধারিত ভাবে কিছু 'ফিলার' মিউজিক দেয়া থাকত। বড়জোর দুই-তিন মিনিটের। উত্তমকুমারের সেই ক্যাসেটের 'এ' পিঠের শেষে এমনি ছিল একটা দুই মিনিটের মিউজিক। যন্ত্র সঙ্গীত। আমার সুখের ঘরে আগুন ফুঁকে দিল ঐ দুই মিনিটের গানটাই। প্রথমবার শুনেই ধরাশায়ী। দ্বিতীয়বার শুনে প্রায় পঞ্চত্বপ্রাপ্তিযোগ হবার অবস্থা। যারা কিন্তু দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ভুগছেন---তাদের কাছে পরিষ্কার করি, গানটা আসলেই আমার 'প্রাণ' কেড়ে নিয়েছিল। মুস্কিল হল এইটা একটা মিউজিক ট্র্যাক। আসল গানটা নেই। মনে একটা ক্ষীন আশার আলো জ্বলে উঠল। হয়ত অপর পিঠে গানটা থাকতে পারে!! হ্যাঁ তেমন কপাল করে এসেছি কি না আমি!! ওই ক্যাসেটের ফিতার প্রতি সেন্টিমিটার আঁতিপাতি করে খুঁজেও এই গান পাওয়া গেল না। সবকিছু ছাপিয়ে রাগটা গিয়ে পড়ল বাবার উপরে। ক্যাসেটটা তিনিই এনেছিলেন কিনা। আমার মনে হতে লাগল--গত সপ্তাহে ব্যাডমিন্টনে তাকে হারিয়ে দেয়ায় এই শাস্তি তিনি আমাকে দিচ্ছেন। অবশ্য ভদ্রলোক ঘোরতর আপত্তি জানালেন আমার এহেন হাইপোথিসিসে। আমার রাগটা আরো বাড়ল যখন বাবা বললেন যে, এই গানটা আসলে তিনি শুনেছেন----কিন্তু কথাটা মনে করতে পারছেন না। এইদিকে দিনকে দিন আমার অবস্থা খারাপ হতে লাগল। সারা ক্যাসেট বাদ দিয়ে কেবল ঐ শেষের দুই মিনিট শুনি। আহা, আহা, কী যে চমৎকার সুর! সারাদিন গানটা গুনগুন করি। মাঝে মাঝে নিজের বানানো কথা বসাই, সেইটে শুনেই উলটো নিজেই নিজেকে শাসাই---আরেকবার যদি এমন করেছিস তো-----!!!

আমার পুড়ন্ত ঘরে ঝরঝর করে আগুন নেভানো বৃষ্টির পানি পড়ল--- এক বৃষ্টির দিনে!
ইস্কুল থেকে ফিরছিলাম। পথে আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি নামল। রিকশাওয়ালা বলল সে নাকি কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। একটু বৃষ্টি ধরে এলে যাওয়া যাবেখন। আমরা আশ্রয় নিলাম এক বইয়ের দোকানে। কিশোর ভারতীর নতুন সংখ্যা এসেছে কিনা সেইটার খোঁজ নিতে যাব---এমন সময় শুনলাম রেডিওতে বেজে উঠল সেই সর্বনেশে গান! আমার ঘরপোড়া গান! এবং আবারো কেবলি মিউজিক!! আমি হয়ত বেশ লম্বাচওড়া একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়েছিলাম যেটা শুনে দোকানের মালিক সপ্রশ্নে তাকিয়ে রইলেন আমার দিকে। বললাম, এই গানটার কথা খুঁজছি আজ হাজার বছর হয়। আমার স্কুল ইউমিফর্মের দিকে ভ্রুঁ কুঁচকে তাকিয়ে হাজার বছরের হিসেবটা ঠিক মেলাতে না পেরে ভদ্রলোক যেন আনমনেই বললেন---ফুঃ, এইটা এত খুঁজতে হয়? এইটাতো সবাই জানে---মনে পড়ে রুবি রায়!

বৃষ্টি ধরে এল।
রিকশাওয়ালা তাগাদা দিল।
কিছু কাস্টমার মার মার কাট কাট করে তেড়ে এল।
কিন্তু আমি দোকানদারকে কেবল একই প্রশ্ন করে যাচ্ছিলাম---আপনি নিশ্চিত তো? আপনি আসলেই জানেন তো? সত্যি বলছেন তো???
বহুদিন পর পাহাড় বেয়ে বাসায় ফেরাটা আমার কাছে ক্লান্তিকর লাগল না।

পরের সপ্তাহটা খুব ব্যস্ততায় কাটল। সিলেটের সব ক্যাসেটের দোকানে ঘোরাঘুরি করা হল। নানান দোকান থেকে যাচাই বাছাই করে করে গানটির আসল পরিচয় নিরূপন করা হল। জানলাম আসলে গানটির গায়ক রাহুল দেব বর্মণ। শুধু তাই নয়--গানটির একটি হিন্দী ভার্সন আছে---মেরি ভিগি ভিগি সি। সেটা গেয়েছেন কিশোর কুমার--আমার ছেলেবেলার হিরো! রাহুলের গানেরও ভক্ত ছিলাম আমি। তার 'যেতে যেতে পথে হল দেরী' গানটা যে কতবার করে শোনা---সেটার ইয়ত্তা নেই। কিঞ্চিত অভিমানও হল রাহুলের উপর। ব্যাটা, এইটা যে তোমার গান সেটা আগে বলে দিলে কী এমন ক্ষতি ছিল? পরে নিজেই নিজেকে সান্ত্বনা দিলাম এই ভেবে যে রাহুল দেবের সাথে আসলে ঠিক নিয়মিত যোগাযোগ নেই আমার---ইন ফ্যাক্ট রাহুল দেবের সাথে ক্যাসেটের মলাটে, পত্রিকার পাতায় দেখা হয়েছে। এই পর্যন্তই। এইসব ভেবেচিন্তে শেষে রাহুলকে ক্ষমা করে দেয়াটাই মনস্থ করলাম। ক্ষমাই মাহুতের লক্ষণ!!

যাই হোক, গানটা (এইবার বাণী সমেত) বগলদাবা করে বাড়ি ফিরলাম। ক্যাসেট প্লেয়ারের ভেতর থেকে হাওয়ায় উড়ে গেলেন উত্তমকুমার---এন্টার দ্য রাহুল দেব!

হা হতোস্মি!!

একি শুনি দাসী মন্থরার ---থুড়ি--রাহুলের মুখে! যে গানটার সুর এতদিন জানা ছিল---জানা ছিল না কেবল কথা। যে কথার লাগিয়া আমার বুকে বাজিয়া ছিল এত ব্যথা---সেই কথার এই হাল?? কে না কে রুবি রায় আর তাকে নিয়ে রাহুল দেব কান্নাকাটি করছেন! তারচেয়ে বড় কথা---গানটার মিউজিক কম্পজিশান উত্তমকুমারের ক্যাসেটে শোনা কম্পোজিশানের চেয়ে আলাদা! আমার 'অতি উন্নত' মস্তিষ্ক অচিরেই বের করে ফেলল কারণটা---খুব সম্ভবত এইটা হিন্দী গানটার ট্র্যাক। মোটের উপর সুরের আদলটা ঠিক থাকলেও প্রিল্যুড আর ইন্টারল্যুড একেবারেই আলাদা। যাচ্চলে! এখন আবার হিন্দীটা খুঁজে বের করতে হবে। ততক্ষণে আমার ব্যগ্রতার ঘোড়ার মুখে রাশ পড়েছে। ভাব্লাম হিন্দীটা না পাওয়া পর্যন্ত বরং এইটেই সই। নাই মামার চেয়ে---

সেই ক্লাশ এইট থেকে রুবি রায় আমার সাথে রয়ে গেছেন। পরে এক সময় হিন্দী ভার্সনটা শোনা হয়েছিল। নিঃসন্দেহে কিশোর কুমারের সেরা ক'টি গানের মাঝে একটি ঐ গানটা। কিন্তু কেন জানি রাহুলের ভার্সনটাই সেঁটে রইল গায়ে। আর আজ বুঝি---কারণটা ছিলেন রুবি রায়!

রুবি রায় এক চিরন্তন মানস প্রতিমা। আমাদের সবার ভেতরে একজন রুবি রায় আছেন। আমি চোখ বুঁজে বলে দিতে পারি-- এমন কোন ছেলেকে খুঁজে পাওয়া যাবে না---যে তার কৈশোরে রুবি রায়ের প্রেমে পড়েনি। হয়ত তার নাম রুবি রায় ছিল না--হয়ত নাম ছিল রুম্পা, টুম্পা, স্বর্ণা, ঝর্ণা কিংবা মুক্তি। কিন্তু ভিন্ন নামের আড়ালে তারা সকলেই ছিলেন আসলে রুবি রায়। রুবি রায় আমাদের কৈশোরের অবধারিত প্রেম। রুবি রায় আমাদের অনেকেরই প্রথম প্রেম। অনেকের প্রথম প্রেমের সমাধি। তার সাথে আমাদের পরিচয় হয়েছে কখনো ইস্কুলে বড় বোনের ক্লাসে বোনকে কলম দিতে গিয়ে। কখনো রুবি রায় ছিলেন আমাদের পাশের বাসার সেই ঝলমলে আপু যার হাসিতে কাঁচের শার্সিতে টোল পড়ত। কখনো রুবি রায় ছিলেন কলেজের বড় আপু। কখনো রুবি রায় পাড়ায় রবীন্দ্র জয়ন্তীতে সব বাচ্চাদের রিহার্সেল করানো ব্যস্তবাগীশ এক উচ্ছল ঝর্ণা। রুবি রায় কখনো আমাদের অংক দেখিয়ে দেন। কখনো আমাদের বলেন একটা রিকশা দেকে দিতে।
আমরা কৃতার্থ হই তার সেবায় লাগতে পেরে।
রুবি রায়-রা অনেক সময়েই আমাদের নাম মনে রাখতে পারেন না। কিন্তু আমরা তাদের মনে রাখি আমৃত্যু। আমরা মনে রাখি তার পছন্দের ফুল, মনে রাখি তার পছন্দের সুগন্ধী, মনে রাখি তার হাসির আওয়াজ, চপল ভ্রুঁ ভঙ্গী। এবং বহু পরে দীর্ঘজীবন পথ পাড়ি দিয়ে মোহনার দিকে যখন অগ্রসরমান, তখন হঠাৎ করেই কারো হাসির নুপুর নিক্কণ, কিংবা কারো অর্ধস্ফুরিত ওষ্ঠাধর মনে করিয়ে দেয় জীবনের এক মহার্ঘ্য প্রাপ্তির কথা---রুবি রায়ের সাথে পরিচয় হবার কথা।

আমার রুবি রায়ের সাথে পরিচয় হয়েছিল বেশ দেরীতেই।
তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষের দিকে পড়ছি। এমনি সময় আমাদের নীরস,নির্জীব জীবনে যেন বৃষ্টির শব্দ হয়ে এলেন ---ধরা যাক, তার নাম---রুবি রায়। একেবারেই একজন ক্লাসিক রুবি রায় ইনি। রুবি রায়েদের কিছু লক্ষণবিচার আছেঃ বয়েসে তারা জ্যেষ্ঠ, অধিকাংশ সময়েই তারা থাকেন আমাদের ধরা-ছোঁয়ার বাইরে, তাদের প্রেমে পড়া যায় বিনিময়ে কোনকিছুর প্রত্যাশা না করেই। অধিকাংশ সময়ে তারা জানেনই না যে একজন নীরবে নিভৃতে পূজা করছে তাকে।
ফিরে আসি 'আমার' রুবি রায়ের কাহিনীতে।
রুবি রায়ের সাথে আমার দেখা হল। কথা হল। তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে কী একটা প্রযুক্তি মেলা হবে বা এইরকম কিছু একটা। রুবি রায় এক বিভাগের প্রভাষিকা। তার কিছু সাহায্য দরকার আঁকিবুকি নিয়ে। আমার এক স্যার আমার নাম করাতে হাওয়ায় ভেসে এলেন তিনি আমার সাথে দেখা করতে। তখন আমরা বিশাল ল্যাবরেটরীর মেঝেতে গোল হয়ে বসে নানান প্রজেক্টের কাজ করছি। ঘাড় গুঁজে প্রায় ক্রীতদাসের মত অবস্থা। ল্যাবের দরজাটা হাট করে খোলা। সারাটা ঘরে ঐটেই একমাত্র আলোর উৎস। ঘাড় গুঁজে কাজ করতে করতেই হঠাৎ টের পেলাম ঘরে আলোটা কেমন জানি একটু মৃদু হয়ে এল। সাথে সাথে ভেসে এল এক অপূর্ব সুঘ্রাণ! ঘাড় ঘুরিয়ে তাকানোর আগেই শুনলাম ভীষন মিস্টি একটা কন্ঠ। এবং অস্টম আশ্চর্য রচিত হল তখনই যখন শুনলাম আসলে আমাকেই খোঁজা হচ্ছে। আমি ঠিক জানিনা আমি কী করেছিলাম বা বলেছিলাম। আমি এটাও জানিনা উনি আমাকে কী বলছিলেন। শুধু জানি আমি এমন কিছু প্রত্যক্ষ করছি, এমন কিছু অনুভব করছি যা আগে কখনো করিনি। মনে আছে উনি চলে যাবার পরও অনেকখন ঐখানে স্থানুবৎ হয়ে রয়েছিলাম। হাতের সকল কাজ ফেলে রেখে তার কাজটা করে দিয়েছিলাম। বার বার রুবি রায় এসে ধন্যবাদ জানিয়ে গেছেন। প্রতিটাবার মনে হয়েছে আমি পৃথিবীশ্রেষ্ঠ বীর। হঠাৎ করেই পৃথিবীর সব্বাইকে খুব আপন লাগতে শুরু করল। এমনকি প্রতিদিন সকালে শ্লেষা-জর্জরিত আসুরিক গলায় 'মায়াবন বিহারিনী হরিণী' গাওয়া ফরিদকে পর্যন্ত ক্ষমা করে দিলাম।
আমার এতদিনের আপাত লক্ষ্যবিহীন জীবনে একটা বড় রকমের অদল-বদল হল। যে আমি সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠতে দশটা করে ফেলতাম--সেই আমি নিয়মিত সকাল সাতটায় উঠে পড়ি। সবার আগে গোসল করে সবচাইতে ভাল জামাটা পরে নাস্তা না খেয়েই ছুটি ক্যাম্পাসের পথে। রুবি রায় ক্যম্পাসে আসেন ঠিক সকাল সাড়ে নয়টার বাসে। সারা পৃথিবীর বদলেও আমাকে ঐ সময়টায় ঘরে আটকে রাখা যেত না। ক্যাম্পাসে এসেই ঘড়ি দেখার পালা শুরু হতো। সেই সাথে নানান চিন্তা। গতকাল কোথায় দাঁড়িয়ে ছিলাম? আজ অন্য কোথাও দাঁড়াতে হবে। রোজ এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলে হয়ত সন্দেহ করবেন। আজকে কি সালাম দেব? নাকি গতকালের মত ব্যস্ততার ভান করে হেটে বেরিয়ে যাব? এবং সব প্রশ্নের বড় প্রশ্ন----আজ কি উনি আমার দিকে তাকিয়ে হাসবেন???

জানি, জানি, আপনাদের বড্ড আমোদ হচ্ছে আমার এহেন নাজেহাল নাজুক অবস্থা দেখে।
অনেকের হয়ত বিরক্তি চড়ছে---ভাবছেন এ কী রকম ছ্যাবলামো রে বাবা!
কেউ কেউ হয়ত চোখ কপালে তুলে ভাবছেন, My God...this is creepy!!
কিন্তু আমার তখন এইসব ভাবনার কোন অবকাশই ছিল না। আমার ভাবনার গাছে তখন নিত্য হাওয়া দিয়ে যান রুবি রায়। ঘড়িতে সাড়ে নয়টা বাজে। আর আমার চারদিকের পৃথিবী থমকে দাঁড়ায়। আমি উলটো দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে থাকি। এইটা আমার প্রিয় একটা খেলা। রুবি রায় যখন আসেন, তার সাথে করে আসে এক অপার্থিব সুঘ্রাণ! আজ এতদিন পর মাঝে মাঝে মনে প্রশ্ন জাগে---আমি আসলে তার প্রেমে পড়েছিলাম? নাকি তার সুগন্ধীর? যা হোক, আমার খেলাটা ছিল এই রকম। ডিপার্টমেন্ট বিল্ডিং এর মেইন গেটে আমি উল্টোমুখী হয়ে দাঁড়িয়ে রইতাম। শুধু তাই নয়। চোখ বন্ধ করে। সকাল বেলা ডিপার্টমেন্টের মেইন গেটে চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে থাকাটা যে কী পরিমান রিস্কি সেটা বলে বোঝানো যাবে না। ছাত্রছাত্রীরা অহরহ আসা-যাওয়া করছে। এরমাঝে কল্পনা করুন--আপনি চোখ বন্ধ করে গেটে দাঁড়িয়ে আছেন রাস্তার দিকে পিঠ দিয়ে। পাগল-ছাগল জাতীয় গালিগালাজ সহ্য হয়ে গেছিল দ্রুতই। কিন্তু মুস্কিল হল বন্ধুদের কাছ থেকে ব্যাপারটা চেপে রাখা নিয়ে। একবার যদি টের পায় যে ডাল মে কুছ কালা হ্যায়, তাহলে আমার একেবারেই 'হায় হায়' করে দেবে ওরা। রুবি রায়ের বিষয়টা জানুক বা না জানুক সেটা ভিন্ন প্রসঙ্গ---আমি ভর সকালে মেইনগেটে চোখ বুঁজে দাঁড়িয়ে আছি এইখবরটুকুই আমার জীবনটা ছারখার করে দেবার জন্যে যথেষ্ট।

সবকিছুর পরও আমার কাছে ব্যাপারটা তখন নেশার মত হয়ে গেছে। ততদিনে প্র্যাক্টিস করে করে চোখ পর্যায়ক্রমিক ভাবে খোলা বন্ধ করতে পারি---যাতে লোকের সন্দেহ না হয় (একবার অবশ্য ধরা পড়ে গেসলাম--বন্ধু যখন অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, কি রে এইখানে চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? আমার উত্তর ছিল---আসলে গতরাতে ঘুম হয় নি তো--)। এত কষ্ট (!) সার্থক হয়ে যায়--যখন রুবি রায় আসেন। রুবি রায় উচ্ছল, প্রানবন্ত--কবি নজরুলের ভাষায় 'প্রকৃতির মত সচ্ছল'! তার সাথে কেউ থাকলে তিনি অনবরত কথা বলতে-বলতে-হাসতে-হাসতে আসেন। আমি তার হাসির শব্দ দুই মাইল দূর থেকেই শুনে চিনতে পারি। মজাটা হয় যখন তিনি একলা আসেন। আমি চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে। রুবি রায়ের কোন হাসির শব্দ, কোন কথার আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি না। ঠিক তখনই ঘটে এক অলৌকিক ঘটনা! আমি নিশ্চিত ভাবে টের পাই--বাতাসটা আমার আশে পাশে বদলে যাচ্ছে। একটু একটু করে পালটে যাচ্ছে তার ঘ্রাণ, কেমন যেন হালকা হয়ে যাচ্ছে বুকের ভেতরটা। আমি আমার সকল মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করি। খুব আস্তে করে নিজেকে বিযুক্ত করে ফেলি আশেপাশের পৃথিবীটা থেকে। নিজেকে সন্তর্পনে নিয়ে যাই এমন এক পৃথিবীতে যেখানে শুধু আমি আছি---আর আছেন রুবি রায়---আর এক ব্রহ্মান্ড ভরা সুগন্ধী হাওয়া!

রুবি রায় আমার প্রথম প্রেম না হলেও---অন্যতম প্রেম তো বটেই। রুবি রায় আমার একমাত্র প্রেম--যাকে আমি কখনো মুখ ফুটে বলিনি মনের কথা। রুবি রায়ের কাছে আমার চাওয়ার কিছু ছিলনা। পাওয়ারও ছিলনা কোন প্রত্যাশা। তাকে ভালবাসতাম এক পূজারীর নিষ্ঠা নিয়ে। আমি ভীষন সুখী ছিলাম সেই সময়ে। অথচ সেই সময়ে আমার সুখী থাকার কথা ছিলনা। প্রচন্ড এক কষ্টের সময় পার করছিলাম আমি। রুবি রায়ের কাছে আমার আমৃত্যু ঋণ---তিনি আমাকে বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন। রুবি রায়ের জন্যেই জীবনে প্রথম বারের মত জানতে পেরেছিলাম---পৃথিবীতে কিছু ভালবাসা এখনো লৌকিক চাওয়া-পাওয়ার উর্ধে থাকে।

রুবি রায় কিছুদিন পরে আমাদের ভার্সিটি ছেড়ে চলে যান বিদেশে। উচ্চ শিক্ষালভ্যার্থে। যাবার আগে অবশ্য একটা জরুরি দায়িত্ব পালন করে যেতে ভুলেন নি। আমার বাবার একবন্ধুর মেয়ে ছিলেন তিনি। বিয়ের চিঠি দিতে তিনি নিজেই এসেছিলেন বাসায়।

আমি সেদিন বাসায় ছিলাম না।

বহুবছর পরের কথা।
আমি নিজেও এখন দেশের বাইরে। সেই একই কারণে। উচ্চ শিক্ষালাভ। ক্রমাগত ভুল মানুষের প্রেমে পড়ে পড়ে নিজেকে ক্লান্ত-শ্রান্ত করে তুলেছি। হঠাৎ একদিন একজনের জন্মদিনের দাওয়াতে গিয়ে টের পেলাম আমার আশেপাশের বাতাসে যেন একটা চেনা চেনা গন্ধ। প্রায় দশ বছর পর আমি আবার ঘর ভর্তি মানুষের মাঝে চোখ বন্ধ করতে গিয়ে হেসে ফেললাম। জীবনটা কি আর হিন্দী সিনেমা! পরে জন্মদিনের পার্টির এক কোনায় যখন চুপটি করে বসেছিলাম তখন হঠাতই কানে ভেসে  এল পরিচিত একটা হাসির শব্দ।

আমি তার কাছে গিয়ে বললাম, রুবি রায়, চিনতে পারছেন??



No comments: