Thursday, June 9, 2011

কারে দেখাব মনে দুঃখ--

বছর পনেরো আগের কথা।

তখন কুমিল্লার একটা প্রত্যন্ত গ্রামে চাকরী করি।ভাঙ্গাচোরা একটা সরকারী কলেজ। দূর থেকে দেখে বড় জোর হাইস্কুল মনে হয়। সেইখানে পদার্থবিজ্ঞান পড়ানোর অপচেষ্টা করি। ক্লাসে গোটাবিশেক ছাত্র ছাত্রী। তাদের মুখগুলো সব সময়ে আনন্দে উৎসাহে ঝলমল করছে। আমি কেন জানি এইসব দেখে উৎসাহ বোধ করি না খুব একটা। প্রতিদিন সকালে যাই। টিচারদের কমন্স রুমে বসে পত্রিকা পড়ার চেষ্টা করি।  ...বছর পনেরো আগের কথা।

তখন কুমিল্লার একটা প্রত্যন্ত গ্রামে চাকরী করি।ভাঙ্গাচোরা একটা সরকারী কলেজ। দূর থেকে দেখে বড় জোর হাইস্কুল মনে হয়। সেইখানে পদার্থবিজ্ঞান পড়ানোর অপচেষ্টা করি। ক্লাসে গোটাবিশেক ছাত্র ছাত্রী। তাদের মুখগুলো সব সময়ে আনন্দে উৎসাহে ঝলমল করছে। আমি কেন জানি এইসব দেখে উৎসাহ বোধ করি না খুব একটা। প্রতিদিন সকালে যাই। টিচারদের কমন্স রুমে বসে পত্রিকা পড়ার চেষ্টা করি। ঢাকা থেকে আসেন আরো কিছু শিক্ষক। তাদের সাথে মাঝে মধ্যে একটা দু'টো কথাবার্তা। সমাজবিজ্ঞানের শিক্ষক (ভদ্রলোকের নাম ভুলে গেছি--কিন্তু চেহারাটা আজও পরিষ্কার মনে আছে--দশাসই চেহারা, তার সাথে মানান সই কন্ঠ) কমন রুমে ঢুকেই দরাজ গলায় ডেকে উঠতেন, 'কি খবর তারেক আজিজ সাহেব? আজ মন ভাল তো?' তারপর উত্তরের অপেক্ষা না করেই বেয়ারা আরব আলীকে হাঁক দিতেন,

'আরব আলী, প্যান্টটা একটু ছেড়ে দাও দেখি--'

প্রথম যেদিন শুনেছিলাম, সেদিন বিষম-টিষম খেয়ে নাজেহাল অবস্থা। ইংরেজীর হায়দর ভাই পাশে বসে ছিলেন। চোখ টিপে জানালেন এখানের অনেকেই 'প' আর 'ফ'  এর মাঝে তেমন একটা তফাৎ করতে পারেন না। আমাদের একজন ম্যাডাম ছিলেন যার নাম ছিল ফারজানা। ভীষন মিশুকে একজন মানুষ। উনিও খুব সম্ভবত সমাজবিজ্ঞানেরই শিক্ষিকা হবেন। তো আমাদের সেই প্রথমোক্ত ভদ্রলোক একদিন প্রিন্সিপাল স্যারের রুম থেকে বেরিয়ে এসে আরব আলীকে জানালেন,

'আরব আলী, তুমি একটু পারজানা ম্যাডাম কে স্যারের রুমে ফাটিয়ে দাও তো--'

হাসি থামানোর জন্যে সেদিন আমাকে কমন রুমের বাথরুমে আত্মগোপন করতে হয়েছিল। আরো ছিলেন অংকের মান্নান স্যার। সর্বদা পান ঠাসা মুখ। পাশে দিয়ে গেলে জর্দার ভুর ভুর গন্ধ আসত। দুপুরের দিকে সব ক্লাস শেষ হলে একটা খালি ক্লাসে বসে তিনি ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে টিউশনি করতেন। তখন পাশ দিয়ে হেঁটে গেলে শোনা যেত স্যার রোষকষায়িত লোচনে ছাত্র-ছাত্রীদের বোঝানোর চেষ্টা করছেন,

'বুইঝলা কিনা, AB আর CD পরস্পরকে E বিন্দুতে ছেদ কইরেসে--'

'E বিন্দুতে ছেদ' বলার সময়ে স্যার প্রয়োজনের চেয়ে একটু বেশি জোর দিতেন। ঐসময় স্যারের ভাঁটার আগুনের মত জ্বলজ্বলে চোখ, মুখের কষ বেয়ে নেমে আসা রক্তরাঙা তাম্বুলরস আর মাথার আলু-থালু কেশ---সবমিলিয়ে কেমন যেন একটা ভ্যাম্পায়ারের মত দেখাত। আড়চোখে চেয়ে দেখেছি ওই সময়ে ছাত্র-ছাত্রীরাও ভয়ে খানিকটা শিউরে উঠত। অবসর সময়ে আমরা সবাই মান্নান স্যারের মত চোখ পাকিয়ে 'AB আর CD পরস্পরকে E বিন্দুতে --' প্র্যাক্টিস করতাম।

দুপুরে বুয়ার রান্না করা বিস্বাদ ভাত-তরকারী গলাধঃকরণ করা, সন্ধ্যে হয়ে আসলে ইংরাজির হায়দর ভাই, কেমিস্ট্রির বশির ভাই আর অর্থনীতির আরিফ ভাই কে নিয়ে গ্রামের রাস্তায় হাঁটতে বেরুনো---এই ছিল আমার রুটিন! সারা গ্রামে একটা মাত্রই চারতলা বিল্ডিং। ছাত্রদের হোস্টেল হিসেবে বানানো হয়েছিল। সেখানে আমাদের এই চার ব্যাচেলর শিক্ষককে থাকতে দেয়া হয়েছিল।

সেই গ্রামে আমি দীর্ঘ দুই বছর ছিলাম। সময় হিসেবে দুই বছর হয়ত খুব একটা বেশি সময় নয়। কিন্তু আমার মনে হত আমি যেন কোন এক অন্ধকার জগতে আটকা পড়ে আছি অনাদিকাল হতে। আমার কোন নিস্তার নেই, কোন উত্তরণ নেই, কোন নির্বাণ নেই। সন্ধ্যার পর সে গ্রামে প্রানস্পন্দন থেমে যেত। তখন মনে হত আমাকে যেন কোন এক তেপান্তরের মাঠে নির্বাসন দেয়া হয়েছে। আশে পাশে কিচ্ছুটি নেই। বিশাল একটা মাঠ, এক পাশে মজা পুকুর, দরমার বেড়া দেয়া স্কুলঘর---আর এদের পেছন থেকে মাঝে মাঝে উঠে আসত এক অলৌকিক চাঁদ। মাঝে মাঝে রাতে যখন হাঁটতে বেরুতাম-- তীব্র এক বিষাদ  আমাকে গ্রাস করে নিত। একা একা হাঁটতাম গ্রামে পথে পথে। তখন আবার সন্ধ্যা হলেই কারেন্ট চলে যেত। কোন কোন রাতে কারেন্ট আসত--কোন কোন রাতে আসতই না।  অন্ধকার সে রাতগুলোয় বিশাল স্কুল মাঠে চেয়ার পেতে বসে থাকতাম আমরা চারটি প্রানী। বশির ভাই প্রবল বিক্রমে ঘন্টাখানেক প্রিন্সিপাল স্যারের বদনাম করে শেষে চুপ করে যেতেন।

কেউ কোন কথা না বলে বসে রইতাম ঘন্টার পর ঘন্টা। সেইসব আলোহীন প্রাণহীন রাতে মাঝে মাঝে কানে ভেসে আসত অপার্থিব কিছু সুর। আমাদেরই কলেজের একটা ছেলে। বখাটে হিসেবে তার বেশ নামডাক। প্রতিবার এইচ এস সি পরীক্ষার সময় নকল করে ধরা পড়ত। ফেল করত। মাঝে মাঝে আমাদের 'সাইজ' করে দেবার হুমকি ধামকি দিত। আবার গ্রামের হাটে দেখা হলে রিক্সা থেকে লাফ দিয়ে নেমে রিক্সাটা দিয়ে দিত---শতবার আপত্তি জানানো সত্ত্বেও। কোনবার তাকে বিশ্বাস করানো যায়নি যে আমরা স্রেফ হাঁটতে বেরিয়েছি---রিক্সার দরকার নেই।

সেই ছেলেটা জোছনা রাতে মাতাল হয়ে গান ধরত। ঘাড়ে-গর্দানে চেহারা, মুখে সব সময় একটা ক্রুর হাসি ঝুলছে---সেই ছেলেটা জোছনা রাতে মাতাল হত। যার হাঁকেডাকে কলেজের অধ্যক্ষ থেকে বেয়ারা অবধি সবাই তটস্থ রইত---সেই ছেলে জোছনা রাতে গান ধরত। রুপালী আলোয় ভেসে যাওয়া চরাচর, মজা পুকুরে থির হয়ে ভাসা চাঁদ তার বুক ভেঙ্গে বের করে নিয়ে আসত এক বড় দুঃখী মানুষ কে। সে দুঃখী ছেলে গাইত

'কারে দেখাব মনে দুঃখ আমি বুক চিরিয়া
অন্তরে তুষেরি অনল জ্বলে গৈয়া গৈয়া--'

সিলেটের ভাটি অঞ্চলের রাধারমন দত্ত সেই সব অলৌকিক রাতে তার কন্ঠে ভর করতেন। আমরা চারটি প্রানী নিস্তব্ধ হয়ে শুনতাম---দিনের বেলার দানব তার সকল অস্ত্র চাঁদের আলোয় বিসর্জন দিয়ে শোনাচ্ছে কোন এক হৃদয়হীনার কথা---যার কাছে সে নিহত হয়েছে বারংবার---

আমি আজ সে গ্রাম থেকে অনেক দূরে।
সেই মাঠ, সেই মজা পুকুর আমি দেখিনা কতদিন---
হায়দর ভাই, বশির ভাই, আরিফ ভাই, আমি---আমরা সকলেই ছিটকে গেছি একেক দিকে সময়ের টানে--
সময় হয়ত বদলে দিয়েছে আমার সেই ছোট্ট গ্রামটাকেও। হয়ত এখন আর সেই মাঠ নেই, নেই সে পুকুর, নেই প্রিন্সিপাল স্যারের রুমের পাশের সে কাঁঠাল চাঁপার গাছ---
এক সময় যে জায়গাটাকে মনে হত দুর্বিসহ শ্বাসরুদ্ধকর কয়েদখানা, আজ শুধু সেই জায়গাটা এক পলক দেখার জন্যে, শুধু একবার সেই মাঠে জোছনা রাতে ফেরার জন্যে বিকিয়ে দিতে রাজী আমার আত্মা--ঈশ্বর কিংবা শয়তানের হাতে--

আজ আমি পৃথিবীর উলটো পাশে এক নাম-না-জানা শহরে হেঁটে বেড়াই। প্রতিদিন কিছু মুখস্থ মানুষ দেখি। পনেরো বছর আগের যে জীবন আমার কাছ থেকে পালিয়ে গেছে অচিনলোকে তাকে মনে প্রাণে ভুলে যেতে চাই।

কেবল মাঝে মাঝে আকাশ জুড়ে ওঠে এক বিশাল রুপোর থালা---আর আচমকা আমার চারপাশ বদলে যায়। আমার ঘরের বাতি নিভিয়ে জানালা খুলে দিই। জানালা দিয়ে ঘরে নরম পায়ে আসে চাঁদের আলো----তার সাথে আসে কিছু কাঠাল চাঁপার গন্ধ, এক বিশাল মাঠ, জোছনার আলোয় প্লাবিত চরাচর-- আর একটা মাতাল কন্ঠ---

আমার তখন নিশ্বাস ফেলতেও ভয় করে--যদি ভেঙ্গে যায় এই স্বপ্ন আমার--


রাধারমনের এই গানটা আমার সেই হারিয়ে যাওয়া সময়গুলোর জন্যে, সেই মাতাল ছেলেটার জন্যে আর সেইসব অলৌকিক রাতগুলোর জন্যে--

কথা- রাধারমন দত্ত
সুর- প্রচলিত
সঙ্গীতায়োজন, কন্ঠঃ অনিকেত







No comments: