Thursday, June 9, 2011

আমার বাড়ি ছোট্ট বাড়ি--

বাচ্চাদের সাথে আমার কেন জানি কখনোই খাতির হয় না।

কথাটা পুরোপুরি ঠিক না---বরং বলা ভাল, 'খাতির হত না'। অতীত কালে। আমি দেখতাম লোকজন কত অবলীলায় বাচ্চাদের সাথে বন্ধুত্ব করে ফেলে। মিনিটের মাঝে বাচ্চারা তাদের ফ্যান হয়ে যায়। দেখা হবার পাঁচ মিনিটের মাথায় বাচ্চারা তাদের কোলে-কাঁখে-ঘাড়ে চড়ে বসে। ঈর্ষায় আমার চোখ ছোট ছোট হয়ে আসত। উদাস ভঙ্গীতে জানালা দিয়ে বাইরে তাকাতে তাকাতে নিজেকে বলতাম--'দেখিস, একদিন আমরাও--'

আমার এই অবস্থার উন্নতির কোন সম্ভাবনা দেখছিলাম না। শেষে এমন মনে হতে লাগল---আমার নিজের বাচ্চারা যদি দেখা যায় আমাকে পছন্দ করছে না--তখন?? এই ভয়ে বিয়ে-শাদীর প্ল্যান বাদ দিয়ে দিলাম (আরো অনেক কারণের মাঝে এইটা একটা)।

আমার ভাগ্যাকাশে দুর্যোগের মেঘ কেটে গিয়ে সূর্যের দেখা মিলল হঠাৎ করেই।

ডেলাওয়ারে আসার ক'বছর পর সাইফ-প্রজাপতি দম্পতির সাথে পরিচয় হল। দেখলাম তাদের একটা শিশু কন্যা আছে। আমি মনে মনে প্রমাদ গুনলাম। এইরে, এই বাচ্চাও তো দেখা যাবে আমাকে পছন্দ করছে না। অবশ্য ততদিনে বাচ্চাদের কাছ থেকে 'প্রত্যাখ্যাত' হতে হতে এক রকমের সয়ে গেছিলাম। সাইফের মেয়েটা দেখা গেল প্রথম দিনেই আমার কোলে চড়ে বসল। আমি একটু আমতা আমতা করতে লাগলাম। বাচ্চা একটা কোলে এসে বসলে তাকে কী বলা উচিত? কী নিয়ে আলাপ শুরু করা উচিত??
আজকের আবহাওয়া কেমন?
আপনাদের ঐ দিকে এই বৎসর ধান  কেমন হয়েছে ?
ওবামার ইকোনোমিক প্ল্যানটা কতটুকু ফলপ্রসু হবে??
 নাকি, তার নাম জিজ্ঞেস করব শুরুতে? অনেক ভাবনা চিন্তা করে ওর নাম জিজ্ঞেস করাই মনস্থ করলাম। কিন্তু ততখনে সে কোল থেকে নেমে দৌড় দিয়েছে। কেউ কি খেয়াল করে দেখেছেন--পৃথিবীর সব চাইতে ব্যস্ত-সমস্ত লোক আসলে বাচ্চারা! সব সময়ে কিছু না কিছু তারা করছে। নেহায়েত কোন কিছু না পাওয়া গেলে দেখা যাবে ঘরের মধ্যে টেবিলের চার পাশে দৌড়াচ্ছে। আমি এখন পর্যন্ত কোন বাচ্চাকে গম্ভীর হয়ে বসে থাকতে দেখলাম না।

যাই হোক, সাইফ কে জিজ্ঞেস করলাম তার মেয়ের নাম কী? সাইফ বলল, ওর নাম সামারা। নামটা শুনেই একটু চেনা চেনা মনে হচ্ছিল। সেইটা খেয়াল করে সাইফ বলল, বস আপ্নে তো Ring ছবিটা দেখসেন, তাই না? সামারা ছিল--সাইফের আর বলতে হল না। মনে পড়ে গেল সবকিছু। ঐখানে মেয়েটার নাম ছিল সামারা। আমার দেখা দুর্দান্ত রকমের ভয়াবহ কিছু হরর ছবির মাঝে 'রিং' ছবিটা অন্যতম। যাই হোক, হরর মুভি থেকে মেয়ের নাম বাছাই করার কী যৌক্তিক কারণ আছে, দেশে কি নামের অভাব পড়েছিল---এ জাতীয় জন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে সাইফের সাথে বেশ লম্বা চওড়া এক তর্কের প্রস্তুতি নিয়ে নিলাম। সময় সুযোগ বুঝে ব্যাটাকে ক্যাঁক করে ধরে ফেলতে হবে।

সে সুযোগ আর হয়ে উঠে না। এর মাঝে সাইফরা দেখা গেল, আমি যে এপার্ট্মেন্ট কমপ্লেক্সে থাকতাম সেইখানে উঠে আসল। দিনের মাঝে দশ বিশবার করে দেখা হতে লাগল। আমি তখন ধীরে ধীরে রান্নার পাট চুকিয়ে ফেলেছি। আমার প্ল্যানটা ছিল এই রকম--- ধাপে ধাপে প্রথমে রান্না-বান্না বাদ, তারপর খাওয়া-দাওয়া বাদ। এবং এইভাবে এক সময় নিজেকে খাদ্যে 'স্বয়ং-সম্পূর্ণ' করে ফেলার প্ল্যান ছিল। বিনা খাদ্য গ্রহন করেও বেঁচে থাকা সম্ভব---সেইটা প্রমাণের একটা মাস্টার প্ল্যান আমার হাতে ছিল। সাইফ দেখা গেল আমার সেই মহৎ প্ল্যানটা ভন্ডুল করার জন্যে উঠে পড়ে লেগেছে। প্রতিদিন ফোন করে। বলে, কী করেন মিয়া, আইসা পড়েন---আজ 'অমুক-তমুক' রানছি চলে আসেন। প্রথমে কয়েকবার 'খেয়ে ফেলেছি' বলে পাশ কাটিয়েছিলাম। কিন্তু কীভাবে জানি সাইফ বের করে ফেলল কথাটা সব সময়ে সত্যি না। নিরূপায় হয়ে গভীর রাত পর্যন্ত অফিসে কাটানো শুরু করলাম।

আমার এত সাবধানতার পরও দেখা গেল সপ্তাহে দু' তিনবার করে তাদের বাসায় খাওয়া-দাওয়া করছি। সাইফ হাতে কিল মেরে বলল, দাঁড়ান বস, চাকরী একটা পাইয়া লই---আপ্নের রোজ রাইতের খাওয়া এইখানে হবে। আমি মনে মনে প্রমাদ গুনলাম। সমস্যা হল, সাইফের বউ প্রজাপতি অসাধারণ রাঁধে। ব্যাপারটা কী রকম একটু বুঝিয়ে বলি। আয়োজন করে ভাল রান্না অনেকেই করতে পারে। কিন্তু আমার দেখা দুর্ধর্ষ রাঁধুনীদের মাঝে প্রজাপতি একজন---যার কোন আয়োজনের প্রয়োজন নেই। একেবারে সাধারণ চাল-ডাল-শাকসব্জি  দিয়ে চট করে সে দেবভোগ্য খাবার তৈরি করে ফেলতে পারে। তার রান্নার গুনগত উৎকর্ষের কারণে আমার আপত্তি গুলো ক্রমেই দুর্বল হয়ে যাচ্ছিল। তাতে আবার গুরুত্বপূর্ণ ইন্ধন যোগাচ্ছিল তাদের মেয়ে--সামারা। ততদিনে সামারার সাথে আমার 'মোটামুটি' টাইপের একটা বন্ধুত্ব হয়েছে। আমি আসলেই সে দরজা খুলে দিতে আসে। সে বাসার যে খানেই থাকুক না কেন, আমি বেল বাজিয়েছি আর সে দৌড়াতে দৌড়াতে এসে দরজা খুলেনি---এমন ঘটনা বিরল। মাঝে মধ্যে তার মা-বাবা ভুল করে দরজা খুলে ফেললে মাটিতে শুয়ে পড়ে কান্না কাটি। তখন কান্না থামানোর জন্য আমি আবার ঘরের বাইরে যেতাম। সেখান থেকে বেল টিপতাম। এক হাতে চোখ মুছতে মুছতে সামারা হাসিমুখে দরজা খুলে দিত। আমার এই নশ্বর জীবনে এতবড় সম্মান আর কেউ কখনো দেখায় নি। শেষের দিকে এমন হল---আমি সিঁড়ি বেয়ে উঠছি, সেই আওয়াজ শুনে সে এসে দরজা খুলে দিত। এক বিচিত্র অনুভূতি আমার মাঝে খেলা করত। অনেক পরে বুঝতে পারলাম--একেই 'স্নেহ' বলে।

এরমধ্যে একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আমাদের সামনে চলে আসল।
আমাকে কী নামে ডাকা হবে? প্রজাপতি এবং সাইফ কোমর-বেঁধে লেগে পড়ল। সামারাকে অষ্টপ্রহর জপানো হল, আমি 'তারেক আঙ্কেল'। পরের দিন দরজায় বেল টিপেছি। সামারা দৌড়ে এসে দরজা খুলে মুখ ভর্তি হাসি নিয়ে বললঃ

'থায়েক ভাই'!!!---

এরচেয়ে মধুরতর শব্দ আমি আর কখনো শুনেছি বলে মনে পড়ে না। তার বাবা-মা হৈ হৈ করে তেড়ে আসল। আমি খুনীর মত মুখ চোখ করে বললাম---কেউ যদি সামারেকে দিয়ে আমার অন্য কোন নাম শেখানোর চেষ্টা করে, তার কপালে বহুৎ খারাপি আছে। আমার সেই হুমকির কারণেই কিনা জানিনা---আমি পাকাপোক্তভাবে 'থায়েক ভাই' হয়ে গেলাম।

সেই থেকে শুরু।

এখনো আমি তার 'থায়েক ভাই'। আমার যত খারাপ দিনই যাক না কেন---সামারার ঐ একটা ডাক আমাকে পুনরুজ্জীবিত করে দেয়। আমার সকল দুর্যোগে, সকল ঝড়-ঝঞ্ঝায় আমার একমাত্র বাতিঘর সামারা।

সামারা ইদানিং গান গাওয়া শুরু করেছে। বাংলা গান। ছোটদের মুখে যাই-ই শোনা যায় না কেন---সে অমৃতবাণীর মত শোনায়। তার উপরে যদি সে বাচ্চা লর্ড ক্লাইভের উচ্চারণে বাংলা কথা বলে---সেইটার কোন তুলনা হয় না। অনেক আগে মনে আছে---শাবিপ্রবিতে থাকার সময় এলাকার সব বাচ্চাদের নিয়ে একটা গান গাওয়ানোর চেষ্টা করেছিলাম। সেই দঙ্গলে জাফর স্যারের দুই ছেলে-মেয়েও ছিল। তাদের জন্য নির্ধারিত গানটা ছিল--"আমরা সবাই রাজা আমাদেরি রাজার রাজত্বে"। নাবিল আর ইয়েশিম (জাফর স্যারের ছেলে মেয়ে), বাংলাটা তখনও ঠিক কব্জা করে নিতে পারেনি। বেচারারা মাত্র মাস কয়েক হল দেশে এসেছে। ওরা যখন কথা বলে নিজেদের মাঝে--তখন ইংরাজীতে বলে। দেবদূতের মত দুইটি শিশু টুকটুক করে ইংরাজীতে কথা বলছে, আর আমরা হা করে শুনছি--এইটা একটা নিত্য নৈমিত্তিক বিষয় ছিল। যাই হোক, ওদের যখন গান গাওয়ানোর চেষ্টা করা হল, তখন দেখা গেল ওরা লর্ড ক্লাইভের উচ্চারণে গান গাইছে---'আমRa সবাই Raজা আমাদেRi Raজার Raজত্বে"
আহা---সে গান শুনেও আনন্দ!!

আমাদের সামারার অবস্থা ওদের চেয়ে অনেক ভাল বলতে হবে। কিন্তু একটা দেবশিশু গান গাইছে, আমার নিজের মাতৃভাষায়---এরচেয়ে অসাধারণ আর কী হতে পারে? গতকাল সাইফের বাসায় আমরা জড়ো হয়েছিলাম বাংলাদেশের সিরিজ জয় উদযাপন করতে। এক ফাঁকে আমি সামারার কন্ঠে একটা গান রেকর্ড করে নিয়ে আসি। আমার সুপারভাইজার দেশের বাইরে। সুপারভাইজাররা দেশের বাইরে গেলে কেন জানি অমানুষ হয়ে যান। আমার বসও তার ব্যতিক্রম নন। আগামী কাল আমার বেশ বড়সড় একটা রিপোর্ট পাঠানোর কথা। কিন্তু আজ সারাদিন আমি আর কিছুই করিনি। সামারার ঐ গান নিয়ে পড়েছিলাম। অনেকগুলো গানের টুকরো একসাথে করে বসেছি। গানটা ছোটদের হলেও এইটা একটা বিসমপদী তালের গান। বড় মানুষদেরই ঘাম ছুটে যায়। অথচ বাচ্চাটা কী অবলীলায়ই না গানটা গেয়েছে!! এবং আনন্দে গেয়েছে। একটা ছোট্ট মানুষ তার ছোট্ট বুকটা ভরে, মনে আনন্দ পুরে এই গানটা গেয়েছে।

গানটা শুনুন এবং আমাকে ঈর্ষা করুণ! এই অপ্সরা আমাকে 'থায়েক ভাই' নামে ডাকে---আমার আর কী চাই এই পৃথিবীতে।


কন্ঠঃ
সামারা
যন্ত্রানুষঙ্গঃ অনিকেত






























No comments: