Thursday, June 9, 2011

রাতের গল্প


'ভাইয়া খেয়েছে?'

আসমা'র মা মাথা নাড়ে।টেবিলে আয়োজন যৎসামান্য। কিন্তু এক প্লেট সাদা ভাঁপ ওঠা ভাত, একটু সর্ষে-মাখা আলু ভর্তা আর টেংরা মাছের ঝোল---এদের মাঝে কিছু একটা আছে যা ভীষন সুখকর---মানুষের সুখী হবার জন্যে আর কি খুব বেশি কিছুর প্রয়োজন ?

সালাম কে জিজ্ঞেস করলে উত্তর পাবেন--'না'।

সালাম একটা প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে পড়ায়। বেতন খারাপ না। পড়ানোর চাপও তেমন বেশি কিছু না। বাপ-বেটা মিলে দুইজনের এই সংসারে খরচের বাহুল্য নেই বললেই চলে। ইদানিং অবশ্য রাহাত, সালামের ছেলে, টিউশনি ধরেছে একটা। তার নিজের ফোনের বিল আর ইন্টারনেটের বিল সেই দেয়। ইউনিভার্সিটিতে সদ্য সদ্য দাখিল হলে নতুন যে যে উপসর্গ  দেখা দেয় সেসবের খরচা হয়ত সালাম খুশি মনেই মেটাত। রাহাত সেসবের ব্যাপারেও বাবাকে জড়ায় না তেমন। এই নিয়ে সালামের মনে কিঞ্চিত দুঃখবোধ রয়েছে।

এইসব কিছু ছোটখাট জিনিস বাদ দিলে সালামকে একজন গড়পড়তা সুখী মানুষ বলে অনায়াসেই চালিয়ে দেয়া যায়।

আলু ভর্তা দিয়ে ভাত মাখাতে মাখাতে আসমা'র মা কে জিজ্ঞেস করল সালাম
'ভাইয়া কই? রুমে? নাকি বারান্দায়?'
'বারান্দায় দেখসি আধাঘন্টা আগে---একলা একলা বইয়া রইছে--আর--'

এইটুকু বলে আসমা'র মা মুখ টিপে হাসে। সালামে'র কেন জানি 'আর কী করে?' জিজ্ঞেস করতে মন চাইল না। এক মনে মাথা নিচু করে খেয়ে যেতে লাগল। আজ প্রায় দুই সপ্তাহ হতে চলল তারা বাপে-বেটায় একসাথে রাতের খাবার খায় না। এইটা প্রায় অলিখিত একটা চুক্তির মত ছিল তাদের মাঝে। সারাদিনে দেখা হয় না। কিন্তু রাতের খাবার তারা দুই জন এক সাথেই খায়। খেলা নিয়ে, পলিটিক্স নিয়ে, মায় গ্রামীন ফোনের নতুন এড নিয়ে নিত্যদিনের ঝগড়াঝাটি কথা কাটাকাটির মাঝে কিছু একটা নেশার মতো ছিল---যে কারণে রাহাত তার টিউশনির টাইম পর্যন্ত এদিক-সেদিক করেছে রাতের খাবার মিস না করার জন্য। সালামের গ্রাস্ট্রিকের যন্ত্রণা শুরু হবার পর থেকেই রাহাত নিজ উদ্যোগে রোজ রাত ন'টার মাঝে খাওয়ার নিয়ম ঠিক করেছে।  পরীক্ষা বা কোন জরুরি মিটিং না থাকলে সালাম সন্ধ্যে হতেই লিভিংরুমের সোফায় আটক।

এই ব্যাপারটা সালাম কে ভাবাচ্ছে কয়েকদিন ধরেই। এমনিতেই তার একা খেতে ভাল লাগে না। কারোরই লাগে না। প্রথমে ভেবেছিল সাময়িক কোন কিছু। এখন মনে হচ্ছে আর বেশি দেরী না করে রাহাতের সাথে কথা বলা দরকার। একজন বাবা'র তার সন্তানের সাথে যতটুকু বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক থাকলে ছেলেরা বাবাকে 'বড়ভাই' এর কাতারে নামিয়ে আনে---সালামের ধারণা, তাদের মাঝের সম্পর্ক চেয়ে বেশি বৈ কম কিছু নয়। তবে এইটা সালামের নিজের ধারণা। রাহাত নিজে কী ভাবে সেটা তার জানা নেই। সালামের শুধু মনে আছে তার নিজের বাবার সাথে তার কি রকম আড়ষ্ট সম্পর্ক ছিল। ক্লাস এইটে ওঠার পর হঠাৎ করে তার বাবা ঘোষনা দিয়ে বসলেন--তাকে এখন থেকে 'আপনি' 'আপনি' করে বলতে হবে। ছেলেপিলেরা বাবা-মা কে তুমি করে ডাকলে 'বেত্তমিজের' মত শোনায়। ক্লাস এইটে ওঠার পর হঠাৎ করে একজনকে 'তুমি' থেকে 'আপনি' করে ডাকাডাকি শুরু করাটা মোটামুটি অস্বস্তিকর ব্যাপার। কিন্তু সালামের মোটেও অসুবিধা হয় নি। উলটো একরকমের স্বস্তি কাজ করেছে বলেই সে মনে করে। কিন্তু তার মা'র আর 'আপনি'-তে প্রমোশন হয়নি। তিনি 'তুমি'-র ঘেরাটোপেই আটকে ছিলেন শেষাবধি।

ভাত খেয়ে উঠে হাত মুছতে মুছতে সালাম আসমা'র মা কে বলল এক কাপ চা আধা ধন্টা পর বারান্দায় দিয়ে আসতে। সরু করিডোর ধরে বারান্দার পথে যেতে যেতে হঠাৎ করে প্রায় ভুলতে বসা একটা অনুভূতি সালাম কে গ্রাস করে নিল। অনুভূতিটির নাম 'বিপন্নতা'!


গ্রীল দেয়া বারান্দাটার এক কোনায় রাখা ছোট দু'টি মোড়ার একটায় বসে আরেকটায় পা তুলে সিগারেট ফুঁকছে রাহাত।বারান্দায় কোন লাইট নেই। কেবল তার অস্থির হাতের প্রান্তে একটা আলোক বিন্দু ছুটোছুটি করে বেড়াচ্ছে, মাঝেমাঝে নিবু-নিবু হয়েই পর মুহূর্তেই যেন কোন সুখবর পাবার আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠছে!

হালকা একটা গলা খাকাড়ি দিয়ে সালাম বলল, কি হে ইয়াং ম্যান?
প্রথমে একটু চমকে উঠলেও দ্রুত সিগারেট আড়াল করতে করতে রাহাত বলে উঠে ,হ্যালো ওল্ড ম্যান--তুমি তো আমাকে ভড়কে দিয়েছ রীতিমত!

-সরি, তোর সিগারেট খাবার আনন্দের মুহূর্তে বাগড়া দিলাম বলে---ওয়েল, লেট মি টেইক ইট ব্যাক---তোর সিগারেট খাবার আনন্দে বাগড়া দিতে পেরে আমি অতিশয় আনন্দিত--!!

হো হো করে হেসে উঠল রাহাত। অন্ধকার তাদের দু'জনের মুখ আড়াল করে রাখায় তারা জানতেও পারল না যে দুইজন আসলে একই সাথে দুজনের দিকে তাকিয়ে প্রশ্রয়ের ভঙ্গিতে হাসছে।

মোড়া এগিয়ে দিতে দিতে রাহাত বলল, তারপর বা'জান, তোমার খবর-টবর কী?
-আমার তো ভালই, তোর খবর বল--দিনে কয়টা করে খাস?
সাধু-সাজার একটা শেষ চেষ্টা চালাল রাহাত,দিনে কয়টা মানে? কী বলতে চাইছ তুমি?

খুব আরামে কানটা মোচড় দিতে দিতে সালাম বলল, এই তোর স্টীমারের মত থেকে থেকে ধুম্র-উদ্গীরণের কথা জানতে চাইছি আর কি--

বাবা'র হাত থেকে কানটা ছাড়িয়ে নিয়ে তাতে হাত বুলোতে বুলোতে বলল
-বা'জান তুমি না আসলেই ইম্পসিবল!! কাউকে কখনো সাধারণ কথাবার্তায় 'ধুম্র-উদগীরণ' শব্দটা ব্যবহার করতে শুনেছ? আমি তো লাস্ট পাঁচ বছরে কাউকে 'ধুম্র' শব্দটাই উচ্চারণ করতে শুনি নি---

--কথা ঘোরাস না, যেটা জিজ্ঞেস করেছি সেইটার উত্তর দে
--আরে কী মুস্কিল, আমার নামে এইসব কী যা-তা কলঙ্ক রটাচ্ছ তুমি?
-- রা--হা--ত
--ঠিকাছে রে বাবা, দুইটা---দিনে দুইটার বেশি না!
--একটু পরে আসমা'র মা চা নিয়ে আসবে আমার জন্যে। তখন তাকে বলব বারান্দার লাইটটা অন করতে। যদি তখন দেখি এই বারান্দায়  দুইটার বেশি সিগ্রেটের পাছা-----
--উফফ বা'জান, তুমি না ভীষন খ্যাত! সিগ্রেটের পাছা---ওফফ কী অসাধারণ চয়েস অব ওয়ার্ড--পাছা!!
--সিগ্রেটের পাছা কে তাহলে কী বলব বাছা?
--বলবে butt, সবাই যেমন বলে।
--ওয়েল আমাদের সময়ে আমরা ঐসব বাট-ফাট বলতাম না---স্রেফ বলতাম পু--
-- বা--বা, তুমি থামবে?

মাঝে মাঝে ছেলে কে বিব্রত করে সালাম বেশ আনন্দ পায়। এই বয়েসের ছেলেরা আরেকটু ডাকা-বুকো হয়। কথাবার্তায় আরেকটু উগ্র। অন্তত তার সময়ের মাপে রাহাতের কথাবার্তার স্টাইলকে অনেকেই হয়ত মেয়েলি বলে চালিয়ে নেবে।

এরই মাঝে আসমা'র মা চা দিয়ে গেল।

চায়ে চুমুক দিয়ে খানিকটা গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করল সালাম,
--পড়াশোনা কেমন চলছে রে?
--ভালই, খারাপ না।
-- কলেজ কেমন লাগছে?
--ভালই তো, খারাপ না।
--আমি এখন আরেকটা প্রশ্ন করব, সেইটার উত্তরেও 'ভালই তো খারাপ না' বললে তোর কপালে খারাপি আছে বলে দিলাম--

উত্তরে খানিকটা তরল গলায় হেসে রাহাত বলল,আচ্ছা যাও, এখন সিরিয়াস হয়ে উত্তর দেব।

সালাম দীর্ঘ সময় নিয়ে চায়ে চুমুক দিল। মনে মনে কথাগুলো সে সাজিয়ে নেবার চেষ্টা করল। এই কথাগুলো কী ভাবে জিজ্ঞেস করবে বা কিভাবে জিজ্ঞেস করা উচিত--সেই নিয়ে গত কয়েকদিন রীতিমত নিজের সাথে যুদ্ধ করতে হয়েছে। আরো আগেই হয়ত জিজ্ঞেস করত---সাহসের অভাবে পারে নি।

-- সানি-টা কে?
একটু থেমে কিঞ্চিত অস্বস্তি ভরা গলায় রাহাত বলল, একটা মেয়ে।
--যাক, আমি আরো ভেবেছিলাম ছেলে মনে হয়, তাহলে তো সর্বনাশ হতো!

ভেবেছিল রাহাত কথাটায় হাসবে।
রাহাত হাসল না।
কিছুখন চুপ থেকে জিজ্ঞেস করল, তুমি সানি-র ব্যাপারে জানলে কী করে? তুমি আমার সেলফোনের এসএমএস চেক করছ নাকি আজকাল?ভালই--

--না তোর এসএমএস চেক করিনি। কিছুদিন আগে যখন ভোর ছটায় টেবিলে মাথা রেখে আপনি ঘুমাচ্ছিলেন তখন আমি আপনাকে টেনে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিয়েছিলাম, আশাকরি সেটা আপনার মনে আছে?

--আছে।

--তখন আপনার ডেস্কটপের মেসেঞ্জার উইন্ডোতে চোখ পড়ে যায়। সেইভাবেই জানা। দেখতে না চাইলেও কিছু জিনিস চোখে পড়ে যায়--আই ক্যুডনট হেল্প ইট! দ্যাটস ইট। এর বেশি কিছু না।

--হুমম। তো এখন আরো কিছু জানবার আছে তোমার? এই বিষয়ে?

--হ্যা আছে। আমি জানতে চাই তোমার সমস্যা কী।
--তুমি শুধু মুদু এক্সাইটেড হচ্ছ বাবা--
--আমি মোটেও এক্সাইটেড না।
--তুমি এক্সাইটেড। প্রমান দেব? তুমি আমাকে 'তুমি' 'তুমি' করে বলছ। তুমি সাধারনতঃ আপসেট না হলে এইরকমটা কর না। ঠিক বলেছি?

সালাম উত্তর দিল না।

কিছুখন চুপ থেকে সে আবার বলল,
--তোমার সমস্যাটা কী আমাকে বলবে?
--আমি যে কোন সমস্যায় আছি, সেইটাই বা তোমাকে কে বলল?

ঠকাস করে চায়ের কাপ বারান্দায় রেখে সালাম উঠে দাঁড়ায়।স্পষ্টতঃই সে মাথা গরম করে ফেলছে। অনেক কষ্টে নিজেকে সামাল দেবার চেষ্টা করতে লাগল---নিজেকে বার বার বলতে লাগল, রাগারাগি নয়, কোন রকম রাগারাগি নয়--

কিছুটা সামলে নিয়ে সালাম বলল, দেখ রাহাত, তুমি চাইলে আমি সারা রাত তোমার সাথে এই কথা চালাচালির খেলা খেলতে রাজি। সেইটা আখেরে তোমার দুঃখই বাড়াবে। তারচেয়ে বুদ্ধিমানের মত কাজ হবে যদি তুমি আমাকে এই ব্যাপারে সহযোগিতা করো। এখন তোমার ইচ্ছা--

--ঠিকাছে।
--ঠিকাছে কী?
--ঠিকাছে, মানে-- জিজ্ঞেস করো কী কী জানতে চাও।
--গুড, আমি যেমন আগেই বলেছি আমি প্রায় কিছুই জানিনা এই ব্যাপারে। আই জাস্ট হ্যাড আ গ্ল্যান্স অন দ্যাট চ্যাট উইন্ডো। ওয়ান্স এগেইন, ইট ওয়াজ টোটালি আন-ইন্টেনশনাল--
--আমি জানি বাবা, বার বার এইটা বলার দরকার নেই।
--ঠিকাছে।আমি তাহলে আমার কন্সার্ন হবার কারণটা খুব স্পষ্ট করে বলি,কেমন? সেদিনের পর থেকে তুমি স্পষ্টতঃই আউট অব সোর্ট। আজ দু'সপ্তাহ হতে চলেছে তুমি আমার সাথে রাতের খাবার খাও না। এমন না যে তুমি বাসায় নেই। বাসায় থেকেও তুমি আমার সাথে খেতে বসছ না। তুমি স্যারের কাছে পড়তেও যাচ্ছ না অনেকদিন। তুমি বোধহয় ভুলে গেছ তোমার অঙ্কের স্যার আমার বাল্যকালের বন্ধু এবং প্রায়ই তার সাথে আমার দেখা হয়।
আমি জানতে চাইছি, কী হয়েছে যা তোমাকে এমন বিপর্যস্ত করছে? সানি-র চ্যাট উইন্ডোতে আমি যা দেখেছি, সেইটা নিয়ে আমি কিছু বলতে চাই না। এইটা তোমাদের নিজেদের ব্যাপার। কিন্তু আমি মনে করি এমন কোন কিছু যদি ঘটে থাকে যেটা তোমার দৈনন্দিন জীবন-যাত্রাটা কে এতখানি ডিসরাপ্ট করতে পারে---সেটা আমার জানা দরকার, আই ডোণ্ট কেয়ার হোয়াট ইউ থিঙ্ক অব ইয়োরসেল্ভস, আই স্টিল এম ইয়োর ফাদার এন্ড আই হ্যাভ আ রাইট টু--

--কুল ডাউন বাবা। কুল ডাউন। ব্যাপার যতটা খারাপ ভাবছ ততটা কিন্তু নয়।সানি আমাদের ব্যাচের। কিন্তু আমাদের কলেজের না। জাহিদ স্যারের কাছে ব্যাচে পড়তে আসে। সেইখানেই পরিচয়। টুকটাক কথা-বার্তা মাঝে মাঝে হতো। মাঝে মাঝে এদিক সেদিক টুকটাক ঘুরে বেড়ানো।
--এসব কতদিন ধরে চলছে?
--উমম, মাস ছয়েক হবে।
--ক্যারী অন
--কয়েক মাস আগে আমি বুঝতে পারি যে আই এম ফলিং ফর হার! এন্ড ফলিং রিয়েল হার্ড। সেইটা এত কষ্টের সময় গেছে যে তোমাকে বলে বুঝাতে পারব না বাবা। সিগ্রেটটা সেই সময়েই ধরা।--যাই হোক, একদিন সাহস করে সানি কে বলি। সে শুনে বেশ চুপচাপ হয়ে যায়। পর পর ক'দিন আমার সাথে কথা পর্যন্ত হয় না। আমি তখন টেনশনে মারা যাচ্ছি--এমন অবস্থা। যখন ওকে বলেছিলাম তখন ভয় ছিল রিজেকশনের। কিন্তু এখন ভয় ছাড়িয়ে সেইটা একটা অদ্ভূত রকমের যন্ত্রণায় পরিনত হল। মনে হতে লাগল, এরচেয়ে সে 'না' বলে দিক--সেটাও ভাল।কিন্তু কিছু একটা অন্তত বলুক।

একটানা কথা বলে যেন একটু নিঃশ্বাস নেবার জন্যেই রাহাত থামল। সালাম ফেরত এসে বসেছে তার মোড়াটায়। দৃষ্টি দূরে নিবদ্ধ। রাস্তায় একটা ল্যাম্প পোষ্ট অল্প হাওয়ায় একটু একটু দুলছে। সেটারই আলো কিছু গাছের পাতার ফাঁক-ফোকর দিয়ে এসে তার মুখে পড়েছে। সে আলোয় তার পিতার মুখ থেকে রাহাত ঠিক বুঝে উঠতে পারে না সেটা কি গাঢ় কোন বিষাদের প্রতিচ্ছবি নাকি বিপন্নতার।

--যাই হোক, কিছুদিন পরে প্রায় জোর করেই ওকে জিজ্ঞেস করি। সে তখন বলে যে তার অলরেডি একজন পছন্দের মানুষ আছে। আমাদের কয়েক বছরের সিনিয়র। কিছুদিনের মাঝেই স্কলারশীপ নিয়ে দেশের বাইরে যাবেন। কাজেই যাবার আগে বিয়ে না হলেও অন্তত আকদ করে যাবে। মনটা আমার ভেঙ্গে গেলেও ওর ভালোর কথা ভেবেই আমি সিদ্ধান্ত নেই সরে আসার।মুস্কিল হল তারপরে--

--মানে?

--মানে সানি দেখা গেল ধীরে ধীরে আমার উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে।আগের চাইতে বেশি বেশি করে এসএমএস করে,ফোন করে। আমি চাইছিলাম ধীরে ধীরে নিজেকে সরিয়ে নিতে। কিন্তু সানি'র এইসব ব্যবহারের কারণে ব্যাপারটা দিনকে দিন ডিফিকাল্ট হয়ে উঠছিল।বুঝতেই পারছ--

--হুমম, তারপর?

--তারপর এই কিছুদিন আগে, তুমি যেদিন আমাকে টেবিল থেকে এনে  বিছানায় শুইয়ে দিয়েছিলে, সেইরাতে সানি আমাকে জানায় যে সে আসলে আমার প্রেমে পড়েছে। যার সাথে তার বিয়ে হবার কথা, সে লোকটা ভাল হলেও খানিকটা 'bossy'।তাদের দুই পরিবারের মাঝেই খুব ভাল বোঝাপড়া অনেকদিনের। এবং এইটা প্রায় সেটেল্ড ছিল যে একদিন ওদের দুইজনের বিয়ে হবেই। আমার সাথে পরিচয় হবার পর সে নিজেকে নতুন করে জানতে পারছে। আমার সাথে পরিচয় হবার পর সে নাকি মন খুলে হাসতে শিখেছে---এইসব নানান হাবিজাবি!

--হুমম, তারপর?

--আরেকবার 'হুমম, তারপর' বললে তোমার খবর করে দেব!
--হা হা হা--   হাসতে না গিয়েও শেষে হেসে ফেলে সালাম। রাহাত বারান্দার সেই অস্পষ্ট আলো-আঁধারীতে তার বাবার হাসিমুখটা দেখে মুগ্ধ হয়ে যায়।নিজের মনে মনেই বলে- বাবা, তুমি কি জানো হাসলে তোমাকে কী অসাধারণ লাগে!!!

--তো, বল, তারপর কী হল
যাক, বাবা তুই-তোকারীতে ফেরৎ এসেছে। খানিকটা স্বস্তি নিয়ে রাহাত আবার শুরু করে

--মুস্কিলটা হল এই জায়গাতে। আমার একটা অংশ চাইছে সানি কে আপন করে নিতে আর আরেকটা অংশ--
এইটুকু বলে চুপ করে রাহাত।
--আরেকটা অংশ কী বলছে? সালাম শান্ত স্বরে জিজ্ঞেস করে।
--বলছে--বলছে--মায়ের মত বিহেভ না করতে!

এই মুহূর্তে ঘরে বাজ পড়লেও হয়ত সালাম এতটা চমকাতো না। খানিকটা তোতলাতে তোতলাতে সে বলল, এর সাথে তোর মায়ে'র সম্পর্ক কী?

--সম্পর্ক আছে। ধীর শান্ত গলায় রাহাত বলে।
--তুমি যতই ঢাকার চেষ্টা কর না কেন বাবা, আমি জানি আসলে কী হয়েছিল। আমি জানি কিভাবে মা তোমাকে ছেড়ে ঐ লোকটার সাথে চলে গিয়েছিল স্রেফ কিছু টাকার জন্যে আর বিদেশী জীবনের আরামের লোভে।

সালামের মনে হয় চিৎকার করে সে রাহাত কে থামিয়ে দেয়। চিৎকার করে বলে, না এইসব মিথ্যে কথা। তোর মা এইজন্যে আমাকে ছেড়ে যায় নি। কিন্তু কেন জানি তার খুব ক্লান্ত লাগে।

---ব্যাপারটা আসলে তুই যেভাবে বলছিস, ঠিক সে রকম না। আসলে হয়েছিল কি জানিস?--আসলে--
--বা'জান আসলে কী হয়েছিল সেটা নিয়ে আমার কোন মাথা ব্যথা নাই। আমি শুধু জানি তুমি কিভাবে আমাকে বড় করেছ। এইটাই যথেষ্ট। আর মায়ের ঘটনাটার সাথে মিলের কথা বলছিলে বাবা? মিল আছে। আমি যদি আজ সানি-র কথায় সাড়া দিই,সানি হয়ত তার বিয়ে ভেঙ্গে দেবে। তার প্রেমিক সম্পর্কে যতটুকু জেনেছি--ভদ্রলোক অত্যন্ত আত্ম-সম্মান সচেতন লোক। তিনি কষ্ট পেলেও এইটা নিয়ে কোন নোংরামী করবেন না। তার ফ্যামিলিতে হয়ত কাউ-কাউ হবে কিছুদিন---কিন্তু আল্টিমেটলি তারাও মেনে নেবেন, আই এম শিউর!

সালাম অবাক বিস্ময়ে রাহাতের কথা শুনতে থাকে। কেন জানি রাহাতকে এই মুহূর্তে ভীষন অচেনা লাগছে সালামের কাছে।

--কিন্তু আমার দ্বিধাটা অন্য জায়গায়, বাবা। রাহাত বলে চলে,
--আমার নিজেকে কেবলি সেই লোকটার মত লাগছে যে সব জেনেশুনেও মা-কে তোমার কাছ থেকে নিয়ে গিয়েছিল--সে চাইলেই মা কে নিষেধ করতে পারত। মা নাহয় পাগল হয়েছিল। তাই বলে লোকটাকেও কী--

--দ্যাটস ইনাফ রাহাত। থিংস আর নট এজ সিম্পল এজ দে সিম!  মানুষের  সম্পর্ক খুব জটিল প্রক্রিয়ায় কাজ করে। এইটা কোন লিনিয়ার প্রসেস না। ঐ লোকটার দোষ নেই সেটা বলছি না, কিন্তু শুধু তাকে, বা তোর মা কে দোষী করা ঠিক না। হয়ত এতে আমারো কোন দোষ ছিল--

--না, তোমার দোষ ছিল না। রাহাত জোর দিয়ে বলে।
--ইউ ডোন্ট নো দ্যাট। এনি ওয়ে। আমি এই নিয়ে আর কথা বলতে চাইছি না।
--কিন্তু আমি কী করব, বাবা? কী করা উচিত আমার?

এই প্রথম পাঁচফুট আট ইঞ্চি রাহাত কে চট করে ক্লাস ফাইভের ছোট্ট রাহাতে বদলে যেতে দেখল। অবিকল সেই অসহায়তা আর বিপন্নতা তার চোখে।


-ট্রাস্ট ইয়োর হার্ট,সন, ট্রাস্ট ইয়োর হার্ট।
সালাম রাহাতের মাথার চুল এলোমেলো করে দিয়ে আলতো করে একটা চুমু খায় কপালে। বিড়বিড় করে বলে,হৃদয়কে বিশ্বাস করলে ঠকবি অনেক, কষ্ট পাবি তারচেয়েও বেশি। কিন্তু ভুল হোক, শুদ্ধ হোক,মাথা খরচ করে হিসেব করে ভাল থাকার চেয়ে হৃদয়ের কথা শুনে দুঃখে থাকা অনেক ভাল।
গুড নাইট,সন।

বারান্দা ছেড়ে যখন ঘরে ফিরছে সালাম, তখন রাত গভীর হয়েছে শহরে বুকে। হৃদয় যাতনায় বিপন্ন কিছু মানুষ ছাড়া আর কেউ জেগে নেই এই রাতে।






















1 comment:

Anonymous said...

Keno jani, Apnar lekhagulo prar por aonno rokom bhalo laga kaj korlo.....

Subho kamona rilo...